যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষিত হয়েছে সম্প্রতি। নানা কারণে ১৯৭১ এর অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর থেকে এই লোকটির নির্মমতা, নৃশংসতা ও অপরাধের মাত্রা আমার কাছে অনেক বেশি বলে মনে হয়। তার সীমাহীন ঔদ্ধত্য, কপটাচার এবং স্বাধীন বাংলাদেশে তার মন্ত্রীত্ব আমাদের দেশ ও জাতির জন্য এক কলঙ্কময় অধ্যায় হয়ে থাকবে। তার রায়ের পূর্ণ বিবরণী নিয়ে সাকা চৌধুরী - যুদ্ধাপরাধ ও বিচার নামে যে বইটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তার অনুবাদকর্মে আমিও একজন ক্ষুদ্র কর্মী ছিলাম, এটি আমার জন্য অবশ্যই আনন্দের একটি বিষয়। আমার অনুবাদ করা রায়ের অংশটুকু নিজের ব্লগে তুলে রাখলাম। ভবিষ্যতের ইতিহাসে সাক্ষ্য দেবার জন্য।
অভিযোগ নং ৩
এই ঘটনাটি ঘটেছিলো ১৩ই এপ্রিল ১৯৭১ সকাল
৯টায় যাতে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতনচন্দ্র সিংহ নির্মমভাবে খুন হন।
১নং সাক্ষী ডঃ আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একজন রিডার
ছিলেন। তার বয়ানমতে, ২৫ শে মার্চের তাণ্ডব শুরু হবার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হামলা
হতে পারে এই আশঙ্কায় তিনি সহকর্মীদের সাথে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে কুণ্ডেশ্বরী চত্বরে
আশ্রয় নেন। ২রা এপ্রিল তারা হাটহাজারির
কাঠেরহাট গ্রামে আশ্রয় নেন এবং ১০ই এপ্রিল রামগড়ে পৌঁছে সেখানকার স্থানীয় থানায় আশ্রয়
গ্রহণ করেন। তিনি আরও জানান, ২০শে এপ্রিলের দিকে রামগড়ে তাঁর সাথে প্রফুল্ল সিংহের দেখা হয়। প্রফুল্ল তাঁকে বলেন, তার বাবা আর বেঁচে নেই। জিজ্ঞাসাবাদে প্রফুল্ল জানান আর্মি কুণ্ডেশ্বরীতে যায়, তার বাবার সাথে কথা বলে, ফিরে যাবার সময় সালাউদ্দিন কাদের
চৌধুরীর উসকানিতে নূতনচন্দ্র সিংহকে গুলি করে মারে। স্বাধীনতার পর আনিসুজ্জামান দেশে ফিরে কুণ্ডেশ্বরীতে যেয়ে প্রফুল্লচন্দ্র
সিংহের সাথে দেখা করেন এবং নূতনচন্দ্র সিংহের খুনের ঘটনা শোনেন।
প্রফুল্ল তাঁকে জানান, কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক
গোপাল দাস প্রফুল্লকে বলেছেন যে, ১৩ই এপ্রিল পাকিস্তানি আর্মি
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ কুণ্ডেশ্বরীতে প্রবেশ করে। তারা নূতনচন্দ্র সিংহের সাথে কথা বলে ফিরবার পথে সালাউদ্দিন
কাদের চৌধুরীর কথায় ফিরে আসে। নূতনচন্দ্র তখন প্রার্থনারত অবস্থায় ছিলেন।। তারা তাঁকে টেনে হিঁচড়ে মন্দির থেকে বের করে গুলি করে। এরপর মৃত্যুপথযাত্রী নূতনচন্দ্র সিংহের মৃত্যু
নিশ্চিত করতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নিজ পিস্তল থেকে তাঁকে দু’বার গুলি করে। আনিসুজ্জামান পুনরায় জোর দিয়ে বলেন যে প্রফুল্ল তাকে পুরো ঘটনাটির বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্তানী
সরকারের রাজনৈতিক মতবাদের সমর্থক ছিলো এবং গোলাম আজম,মতিউর রহমান নিজামী, ফজলুল
কাদের চৌধুরী প্রমূখ একটি শান্তি কমিটি তৈরি করে এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীও সেই
একই ভূমিকা পালন করেছে।
তার(সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী) মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের পরিধি চট্টগ্রাম
এলাকাতেই সীমিত। এই বিষয়ে জেরার সময় তিনি তাঁর মূল বক্তব্যে অটল থাকেন, নূতনচন্দ্র
সিংহকে হত্যা করার স্থান ও সময়ের ব্যাপারে পুনর্বার নিশ্চিত করেন এবং বলেন যখন
নূতনচন্দ্র সিংহ সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিলেন
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী দুইবার পিস্তল দিয়ে তাঁকে গুলি করে এবং এই ঘটনা
প্রফুল্লচন্দ্র তাঁকে ১৯৭২ এ দু’বার বলেছেন। আসামীপক্ষের এই বক্তব্য তিনি অস্বীকার
করেন যে, প্রফুল্ল তাঁকে ১৯৭২ এ এটি বলেননি বা তিনি ভারত থেকে ফিরে কুণ্ডেশ্বরী
যাননি।
তিনি আসামীপক্ষের এই বক্তব্য অস্বীকার করেন যে, নূতনচন্দ্র সিংহ ১৩ নয় বরং ৭ই
এপ্রিল মারা গিয়েছিলেন। তাঁর বয়ান বাদীপক্ষের বক্তব্যকে সমর্থন করে যে, নূতনচন্দ্র
সিংহ পাকবাহিনী ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন। বয়ানে পুনরায়
জোর দিয়ে বলেন, কুণ্ডেশ্বরীতে আশ্রয়দানের জন্য নূতনচন্দ্র সিংহের কাছে তিনি
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি নিম্নোক্ত বিষয়ে তাঁর অজ্ঞতা প্রকাশ করেন – ১৭ই
এপ্রিল ১৯৭১ দিবাগত রাতে ফজলুল কাদের চৌধুরী
সপরিবারে গহিরা থেকে নিজ বাড়ি গুডস হিলে ফেরার
পথে পাক আর্মি দ্বারা আক্রান্ত হন যাতে গাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং ড্রাইভার
আহমেদ আলি নিহত হয়।
এটি কিছু ক্ষেত্রে বাদীপক্ষের বক্তব্য সমর্থন করে, বিশেষতঃ এই জায়গায় যেখানে
বলা হয়েছে, গণহত্যায় জড়িত থাকার জন্য
মুক্তিযোদ্ধারা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং যখন
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ড্রাইভার আহমেদ আলিসহ ফিরছিলো, মুক্তিযোদ্ধারা ডঃ সমিরুদ্দিনের বাড়ির সামনে স্টেনগান ও গ্রেনেড
নিয়ে তার ওপর হামলা করে। ব্রাশফায়ার ও গ্রেনেড চার্জের ফলে ড্রাইভার ঘটনাস্থলেই
নিহত হয় এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী গুরুতর আহত হয় ২০শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে
ছ’টায়। তিনি পুনর্বার জোর দিয়ে বলেন নূতনচন্দ্র সিংহ হত্যা সম্পর্কে তাঁর বয়ান
সত্য।
সাক্ষী নং ৩ একজন মুক্তিযোদ্ধা যিনি বলেন, ১৯৭০ এর জাতীয় সংসদ
নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে জয়লাভ করে এবং প্রাদেশিক
পরিষদের ৩০০টির মধ্যে ২৮৯টি আসন নিশ্চিত করে। সেসময় পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসক ও রাজনীতিবিদগণ নীতিগতভাবে
এই বিজয় মেনে নিতে পারেনি এবং আওয়ামী লীগের হাতে শাসনভার হস্তান্তরে অনিচ্ছুক ছিলো। আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ব্যাহত করতে তারা কিছু
রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই রাজনৈতিক দলগুলো ছিলো কনভেনশন মুসলিম লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামাত ই ইসলামী, নিজামে ইসলামী, পিডিপি ইত্যাদি এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে
ছিলো ফজলুল কাদের চৌধুরী, গোলাম আজম, আব্বাস
আলী খান, মৌলানা ইউসুফ আলী, খান আব্দুস
সবুর খান, আবদুল মোনায়েম খান, খাজা খায়ের
উদ্দীন, খাজা সাহাব উদ্দীন, শাহ্
আজিজুর রহ্মান, নুরুল আমিন,
এস এম সুলায়মান, শরাফত উল্লাহ, সুলতান আহমেদ, এডভোকেট মোঃ ইয়াহিয়া প্রমূখ।
ইসলামি ছাত্র সংঘ ছিলো জামাতে ইসলামির অন্তর্ভুক্ত ছাত্র সংগঠন এবং তার নেতৃবৃন্দ ছিলো আবু নাসের মোহাম্মদ
আব্দুল জাহর, মোহাম্মদ ইব্রাহীম, মীর কাসেম আলী, এ এন এম মুনীর আহমেদ, মৌলানা আবু
তাহের এবং এম এ তাহের। মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদ ছিলো মূল নেতা।
মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন ছিলো এন এস এফ এবং তারা মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের
নির্দেশে তাদের রাজনৈতিক কার্যাবলী সম্পাদন
করতো। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম, হামিদুল
কবির ওরফে খোকা এবং এনামুল হক মঞ্জু ছিলো ছাত্রনেতা। হামিদুল কবির ওরফে খোকা ছিলো
মুসলিম ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। এইসকল সকল ছাত্রনেতারা নিজ নিজ রাজনৈতিক
দলের নেতাদের নির্দেশে স্বাধীনতাবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত ছিলো।
পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে
গড়িমসি করছিলো যার প্রতিবাদে ১লা মার্চ, ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু
জনগণকে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান এবং একই দিনে তিনি ঘোষণা দেন পরবর্তী
কর্মসূচী ঘোষিত হবে ৭ই মার্চের রেসকোর্সের জনসভায়। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রচ্ছন্ন
সমর্থনে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সর্বোচ্চ আসনপ্রাপ্ত দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচাল
করতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর পরিণামে, কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি বাস্তবায়নকল্পে জেনারেল টিক্কা খান এক ত্রাসের রাজত্ব
কায়েম করে, উন্মত্ত জান্তবতায় নিরস্ত্র জনগণের ওপর নির্মমভাবে
ঝাঁপিয়ে পড়ে ২৫শে মার্চের
দিবাগত রাতে “অপারেশন সার্চ লাইট” নামক
এক সামরিক অভিযানে লক্ষাধিক মানুষকে খুন করে। তিনি আরো জানান, ২৬শে মার্চ ভোরে
চট্টগ্রাম শহরে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে পুলিশ, আনসার ও ইস্ট পাকিস্তান
রুলস(ই পি আর)এর সহায়তায় স্থানীয় রাজনীতিকরা
পাক জান্তাকে প্রতিহত করেছে।
১৯৭০ এর নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের এক তরুণ কর্মীর কাছে
ফজলুল কাদের চৌধুরীর হারের জের ধরে তার পরিবার হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বিদ্দিষ্ট
হয়ে ওঠে, কারণ তাদের ধারণা ছিলো হিন্দুরা তাকে ভোট না দেবার ফলেই ফজলুল কাদের
চৌধুরীর পরাজয় ঘটে। প্রতিশোধ নেবার জন্য ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা
গণহত্যা, লুটতরাজ ও স্থানীয় হিন্দু
সম্প্রদায়কে ভারতে বিতাড়নের কাজ শুরু করে যাতে পরবর্তী নির্বাচনে তার পরিবারের কেউ
আর পরাজিত না হয়। একজন অভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা
ক্যাপ্টেন করিম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার অনুচর সৈয়দ ওয়ালিউল আলমকে শেষ করার
শপথ নেন। ১২ই এপ্রিল রাউজান-হাটহাজারিতে গুজব ছড়িয়ে
পড়ে যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকবাহিনীর সহায়তায় গণহত্যা ঘটাবে।
১৩ তারিখ সকালে হিন্দুরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। ৩নং সাক্ষী বলেন যে, বিভূতিভূষণ তাকে বলেছেন, তিনি ১৩ তারিখ সকালে জগগারঘাট-ফটিকছড়ি যাবার পথে কিছুদূর অগ্রসর হলে দেখতে পান একটি সামরিক বহর কুণ্ডেশ্বরীর
দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিপদ আসন্ন দেখে তিনি দ্রুত কাছের জঙ্গলে লুকিয়ে যান এবং লক্ষ্য করেন বহরটি কুণ্ডেশ্বরীর
সামনে থামে। পাকবাহিনী কুণ্ডেশ্বরীর মূল
ভবনে প্রবেশ করে এবং সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী ও একজন সেনাসদস্য মন্দিরের দিকে অগ্রসর
হয়। এই মন্দিরেই নূতনচন্দ্র সিংহ
প্রার্থনারত ছিলেন। সদস্যটি নূতনচন্দ্রকে টেনে
হিঁচড়ে মন্দিরের বাইরে নিয়ে আসে এবং তখন সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী নূতনচন্দ্রের দিকে
অঙ্গুলিনির্দেশ করে সেনা সদস্যটিকে বলে নূতনবাবুকে শেষ করে দিতে। সদস্যটি নূতনবাবুকে গালিগালাজ করতে থাকলে নূতনবাবু
তার উত্তরে কিছু একটা বলেন কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বর খুব নিচু থাকায় বিভূতিভূষণ তা শুনতে
অপারগ ছিলেন।
সামরিক সদস্যটি বলেনঃ
তারপর সামরিক সদস্যটি ফিরে যায় আর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বুঝতে পারে যে তার
পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যেতে চলেছে, এবং তার কিছুক্ষণ পরে সে আরো কিছু সামরিক
ব্যক্তিদেরকে নিয়ে ফিরে আসে এবং তাদেরকে নির্দেশ দেয় নূতনচন্দ্রকে গুলি করতে।
তারপরে সে নিজে দুইবার নূতনবাবুকে গুলি করে।
এই সাক্ষী অন্যান্য অভিযোগের ব্যাপারেও বয়ান দিয়েছেন যা পরে বর্ণনা করা হবে। জেরার সময় তিনি জানান ক্যাপ্টেন করিম ১৯৭১ এর
সেপ্টেম্বরে মারা যান। এক প্রশ্নের
জবাবে তিনি কুণ্ডেশ্বরীর ভৌগলিক অবস্থান বর্ণনা করেন। তিনি আসামীপক্ষের এই অভিযোগ অস্বীকার করেন যে, তিনি ক্যাপ্টেন করিমকে চিনতেন না। তিনি বলেন যে, ক্যাপ্টেন করিমের
কাছে তিনি ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর হিন্দু সম্প্রদায় বিদ্বেষের
ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন।
করিম তার মূল সাক্ষ্যে বর্ণিত একই বক্তব্য পুনর্ব্যক্ত করেন যে, তাদের মতে,
যারা আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থনে ভোট দিয়েছিল সেই সংখ্যালঘু ভোটারদের
কারণেই ১৯৭০ সালে নির্বাচনের পরাজয় ঘটে। তিনি আসামীপক্ষের এই অভিযোগ অস্বীকার করেন যে, আসামীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্ররোচনায় তিনি আসামীর বিরুদ্ধে ভুল জবানবন্দি
দিয়েছেন অথবা তাঁকে আসামীর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা বাছাই করেছেন অভিযুক্ত সালাউদ্দীন
কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য
দেবার জন্য।
সাক্ষী নং ৪ নিহত নূতনচন্দ্র সিংহের
ভ্রাতুষ্পুত্র। তিনি বলেন হিন্দু একান্নবর্তী পরিবার হিসেবে তারা সবাই গহিরা
গ্রামের “কুন্ডেশ্বরী”তে বাস করতেন। তিনি নূতনচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ ছিলেন ও পারিবারিক বিষয়াদি
দেখাশোনা করতেন। তার কাকা নূতনচন্দ্র সিংহ কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালায় ও তৎসলগ্ন কারখানা
প্রতিষ্ঠা করেন; প্রাথমিক বিদ্যালয়, মেয়েদের বিদ্যালয়, মহিলা মহাবিদ্যালয় ও ছাত্রাবাস গড়ে তোলেন এবং বিশাল পরিমাণ
কৃষিজমি অধিগ্রহণ করেন । তিনি একজন সমাজসেবকও ছিলেন। ১৯৭১ এর যুদ্ধকালীন সময়ে, ৩০
শে চৈত্র তিনি, হিমাংশু বৈদ্য, ব্রজহরি কর্মকার, গোপাল দাস প্রমূখ নূতন চন্দ্রের
সাথে থাকতেন।
নিরাপত্তাজনিত কারণে নূতনচন্দ্র সিংহকে তারা অন্যত্র
সরিয়ে নিতে চাইলেও কাকা তাদের অনুরোধ শোনেননি। সকাল ৯টার সময় যখন তারা আলাপ করছিলেন,
একটি সামরিক জিপ চত্বরে প্রবেশ করে এবং তিনি লক্ষ্য করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
তার ক’জন অনুচর এবং সেনসদস্যসহ গাড়ি থেকে নামছে। তিনি, হিমাংশু ও মনোরঞ্জন দ্রুত
পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে পড়েন। নূতনচন্দ্রের সাথে কথা শেষ করে সালাউদ্দিন কাদের
চৌধুরী,তার সহযোগী ও সৈন্যরা চলে যায় এবং তার ১০-১৫ মিনিট পরে তারা আবার ফিরে আসে
এবং তার অল্পক্ষণ পরেই তারা গুলির শব্দ শুনতে পান। ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে বুঝতে পেরে তারা
অবিলম্বে সেই স্থান ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর তারা পড়শী আহমেদ বাশারের
বাড়িতে যান এবং বাশারকে তার কাকার ভাগ্যে কী ঘটেছে সে ব্যাপারে খোঁজ নেবার অনুরোধ
করেন। আহমেদ বাশার
তাদের বলেন নূতনচন্দ্র সিংহের মৃতদেহ মন্দিরের সামনে পড়ে আছে। এই খবর শুনে তারা ফিরে আসেন এবং মৃতদেহকে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে সেই
স্থান ত্যাগ করেন। তিনি কাকার মুখে ও বুকে গুলির
চিহ্ন দেখতে পান। তার পরদিন তিনি সীমান্ত পার
হয়ে যান এবং স্বাধীনতার ৮/১০ দিন পর বাড়ি ফিরে আসেন।
তিনি বলেন, এর একদিন পর ব্রজহরি কর্মকার তার সাথে দেখা
করতে আসেন। তার কাছ থেকে তিনি শোনেন
যে ঘটনার দিন ব্রজহরি ও গোপাল দাস ওই দালানের দোতলায় ছিলেন। সেখান থেকে তারা দেখেছিলেন, সালাউদ্দিন
কাদের চৌধুরী কিছু বাঙালি অনুচর আর পাঞ্জাবি সেনাসদস্যসহ তার কাকার সাথে কথা বলার পর
আবার ফিরে আসে। তারা কাকাকে
মন্দির থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এবং প্রথমে সেনাবাহিনী ব্রাশফায়ার করে এবং তারপর সালাউদ্দিন
কাদের চৌধুরী নূতনচন্দ্রকে লক্ষ্য করে গুলি করে। ব্রজহরি জানায় তার কাকার মৃতদেহ ২/৩ দিন যাবত পড়ে ছিলো। চেয়ারম্যান আমানত খাঁ বড়ুয়া পাড়ার লোকদের সহযোগিতায় তার সৎকারের ব্যবস্থা করেন। বাড়ি ফিরে আসার পর রাউজান থানায় সত্যরঞ্জন একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নূতনচন্দ্র
সিংহ এর খুনের জন্য- মামলা নং ৪১(১)৭২ এবং দ্বিতীয় আরো একটি মামলা দায়ের করেন লুন্ঠনের -মামলা নং ৪২(১)৭২।
তিনি স্বীকার করেন যে ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথে তার কাকার সদ্ভাব ছিলো এবং সালাউদ্দীন
কাদের চৌধুরী নূতনচন্দ্রকে কাকা সম্বোধন করতেন। তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন যে ১৯৭১ সালে, ৩০শে চৈত্র তারিখে
তিনি, হিমাংশু বৈদ্য, ব্রজহরি কর্মকার, গোপাল দাস এবং নূতনচন্দ্র সিংহ একত্রে
বাড়িতে ছিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বুলেট ক্ষতের কারণে তার কাকার মাথার বাঁ
পাশের মাংস ও ত্বক ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিলো। তিনি জানান পাকবাহিনী ভবনের দোতলায়
প্রবেশ করেনি। তার এই জবানবন্দি প্রমাণ করে যে, তিনি নূতনচন্দ্র সিংহের সাথে ছিলেন
এবং তিনি মৃতদেহটি দেখেছেন। তিনি আসামীপক্ষের এই অভিযোগ অস্বীকার করেন যে, তিনি
শত্রুপক্ষের প্ররোচনায় ভুল জবানবন্দি দিচ্ছেন এবং এও অস্বীকার করেন যে নূতনচন্দ্র
সিংহের শত্রুরা তার সম্পত্তি দখলের নিমিত্তে তাকে হত্যার জন্য সেনাবাহিনী নিয়ে আসে।
এই বক্তব্য আরো প্রমাণ করে যে, নূতনচন্দ্র সিংহ
সেনাবাহিনী কর্তৃক সেই দিন এবং সেই প্রক্রিয়াতেই নিহত হন। আসামীপক্ষের বক্তব্যে এ স্বীকারোক্তি স্পষ্ট
যে নূতন চন্দ্র সিংহকে সেনাবাহিনীই হত্যা করে, শুধু এটুকু বাদে
যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আসামীপক্ষ যদিও সনাক্তকরণে ব্যর্থ হয়েছেন যে কারা নূতনচন্দ্রের
ক্ষতি করতে চেয়েছিলো, যাদের প্ররোচনায় সেনাসদস্যরা এসেছিলো এবং তাঁকে
হত্যা করেছিলো।
সাক্ষী নং ৫ প্রাসঙ্গিক বিবরণ দ্বারা সাক্ষী নং ৪ এর বক্তব্যের যাথার্থ্য
প্রতিপন্ন করেছেন। তিনি নিহত নূতনচন্দ্র সিংহের পুত্র। পুনরাবৃত্তি রোধে আমি
কুণ্ডেশ্বরী প্রতিষ্ঠানসমূহের স্থাপন এবং চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত ব্যক্তিবর্গের
সাথে তাদের পারিবারিক সম্পর্কের পুনরুল্লেখ থেকে বিরত থাকছি। সাক্ষী নং ৪ এর তথ্য
যাচাইকালে তিনি বলেন, নির্বাচনপূর্ব সময়ে ফজলুল কাদের চৌধুরী তাদের গ্রামে এসে
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বলে যে, সে বিশ্বাস করে যদি তারা ভোটকেন্দ্রে না যায় তবেই
সে তাদের ভোট পাবে; যারা এ পরামর্শ উপেক্ষা করে ভোট দিতে গিয়েছিলো ফজলুল কাদের
চৌধুরীর লোকেরা তাদের অত্যাচার করে যার প্রতিক্রিয়ায় স্বয়ং বঙ্গবন্ধু সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়ের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে রাউজানে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার বাবার
সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছিলেন এবং প্রত্যুত্তরে তার বাবা
তাঁকে বলেছিলেনঃ ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করবেন। ১৯৭০ এর নির্বাচনের আগের রাতে ফজলুল
কাদের চৌধুরী যখন তার বাবার সাথে সাক্ষাৎ
করতে আসেন তখন তিনি সেখানেই উপস্থিত ছিলেন।
ফজলুল কাদের বলেঃ
এবং এইরকম বাক্যালাপের পরে রাত ১১টার সময় সে চলে যায়। রাত ১২টার সময় ফজলুল
কাদের চৌধুরী ফের এসে তার বাবার সাথে কথা বলে এবং তার বাবা তাকে বলেন,“ও চৌধুরী
অহনে কি ফয়ল হই গেইয়না।” ফজলুল কাদের
চৌধুরী তার বাবাকে বলে, সে আশংকা করছে নতুন ছেলেটি তাকে হারিয়ে দেবে যার উত্তরে
নূতনচন্দ্র তাকে বলেন যে, চৌধুরী আপনি হারলে এমন তো নয় যে আপনার জমিদারি চলে যাবে; চৌধুরী
প্রত্যুত্তরে বলে, নূতনবাবু সহজসরল মানুষ তাই তিনি নির্বাচনে হারের পরিণতি
ঠিক বুঝতে পারছেন না।
তিনি তার সাক্ষ্যে আরও উল্লেখ করেন, ফজলুল
কাদের চৌধুরী নির্বাচনে হেরে যায় এবং আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরীসহ ডঃ আলমও
পরাজিত হন। তার পর থেকেই সে হিন্দু
সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন শুরু করে। তিনি জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ
আনিসুজ্জামান ও ডঃ এ আর মালিক তার কাকাকে খবর পাঠান যে তারা কুণ্ডেশ্বরী চত্বরে আশ্রয় নিতে চান ।পরবর্তীতে
২৭টি পরিবারের ৫০ জন সদস্য তাদের স্কুল চত্বরে আশ্রয় গ্রহণ করে। আব্দুল্লাহ আল
হারুন চৌধুরী, ডঃ আবু জাফর এবং এম এ হান্নান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে আসতেন
এবং কীভাবে সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করা যায় সেই পরিকল্পনা করতেন। কী করে গণগ্রেফতার
এড়িয়ে ভারতে চলে যাওয়া যায় সে বিষয়ে আলাপ করতে এ আর সিদ্দিক, আলহাজ্জ্ব জহুর আহমদে
চৌধুরী, আতাউর রহমান কায়সার প্রমূখ ৩০ শে মার্চ তাদের বাড়িতে আসেন। সেই সময় তার বড়
ভাই চিত্ত সিংহ এক বন্ধুসহ কলকাতা থেকে এসেছিলেন। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন
সিংহের সাথে সখ্যের সুবাদে সেই বন্ধুটি তাদের তাঁদের আশ্বস্ত করেন যে, ভারতের সাহায্য
প্রয়োজন হলেই তিনি সহায়তা করবেন।
ব্রজহরি তাকে বলেন, সেনাবাহিনী যখন কুণ্ডেশ্বরীতে ঢুকেছিলো তখন তিনিও
সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরীকে তাদের সাথে দেখেছিলেন। গৌরাঙ্গ, হিমাংশু, মনোরঞ্জন,
ব্রজহরি এবং গোপাল মিলে তার বাবাকে অনুনয় করেন নিরাপদ স্থানে সরে যেতে। কিন্তু তার
বাবা কুণ্ডেশ্বরী চত্বর ত্যাগে অস্বীকৃতি জানান। সেনাসদস্যদের আসতে দেখে তারা
নিকটস্থ জঙ্গলে লুকিয়ে পড়েন আর অন্য দু’জন ভবনের দোতলায় চলে যান। ব্রজহরি তাদের
বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ সেনাসদস্যরা তার বাবার কাছে মূল্যবান গার্হস্থ্য ধনসম্পদ
ইত্যাদি দাবী করলে বাবা তাদের সব দিয়ে দেন এবং তারা চলে যায়। ১৫/২০ মিনিট পরে তারা
আবার ফিরে আসে এবং তার বাবাকে টেনে হিঁচড়ে মন্দির থেকে বের করে মন্দিরের সামনে
দাঁড় করিয়ে রাখে এবং তখন তাঁকে গুলি করে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী যখন পুনরায় গুলি
করে তখন নূতনচন্দ্র কাঁপছিলেন। তারা বাবার মৃতদেহ সেখানে তিনদিন পড়েছিলো,
পরবর্তীতে আমানত খাঁ ও বড়ুয়া বাবুর সহায়তায় সেই দেহের সৎকারকার্য সম্পাদিত হয়।
পরবর্তীতে তার ভাই সত্যরঞ্জন তার বাবার হত্যা মামলা দায়ের করেন - রাউজান মামলা
নং ৪১(১)৭২ এবং রাউজান পুলিশ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে
অভিযোগপত্র দাখিল করে। সমস্ত নথিপত্র ঢাকায় পাঠানো হয় কিন্তু সেই মামলার পরিণতি
সম্পর্কে তিনি কিছু জানতে পারেননি। ডঃ আনিসুজ্জামানের (সাক্ষী নং ১) সাথে দেখা করলে
তিনি তার বাবার ভাগ্য কী ঘটেছে তা জানতে চান। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও অন্যরা
মিলে তার বাবাকে খুন করার সংবাদ তিনিই ডঃ আনিসুজ্জামানকে দেন। কুণ্ডেশ্বরী ভবন ও
চত্বরের স্থানবিবরণ সম্পর্কে তাকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জেরা করা হয়। তিনি চত্বরটির
বিশদ বর্ণনা দেন এবং রাজনীতিবিদ ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর পরিবারের সাথে তার বাবার
সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। তিনি আসামীপক্ষের এই অভিযোগ অস্বীকার করেন যে, তিনি
হারুনের প্ররোচনায় তার ভাইয়ের মাধ্যমে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও অন্যান্যদের
বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছেন। লম্বা জেরার মুখেও তিনি তার মূল সাক্ষ্য থেকে
বিচ্যুত হননি। তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দোতলার যে ঘর থেকে তিনি ঘটনাটি প্রত্যক্ষ
করেন সেই ঘরটি দেখান এবং সেই কর্মকর্তা
একটি মানচিত্র এঁকে পুরো স্থানের বিবরণী লিপিবদ্ধ করেন। তিনি জানান তার বাবা
ভবনের নিচ তলায় এবং অন্যরা দোতলায় থাকতেন। বহুদিন ধরে তাকে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা
হয় এবং তিনি আসামীপক্ষের এই অভিযোগ অস্বীকার করেন যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এই
ঘটনায় জড়িত ছিলোনা।
সাক্ষী নং ১৮ গোপালচন্দ্র দাস আরেকজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তিনি জানান, তিনি
নূতনচন্দ্র সিংহ প্রতিষ্ঠিত কুণ্ডেশ্বরী মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং ১৯৭০
সালে সেখানে যোগ দেন। ১৯৭১এ কুণ্ডেশ্বরী
চত্বরে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। ঘটনাটি ঘটে ১৩ই এপ্রিল এবং তিনি সেই ঘটনার
চাক্ষুষ সাক্ষী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০টি পরিবার সেখানে আশ্রয় নিয়েছে জানতে
পেরে কিছু পাকিস্তানি সেনাসদস্য সেখানে আসে। এদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান, ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ
রশীদুল হক, ডঃ মাহমুদ শাহ্ কুরাইশী প্রমূখ। প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান দেশের
ক্রমবর্ধমান জটিল পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তাই তারা কুণ্ডেশ্বরী চত্বরে
আশ্রয় নেন।
১০ই এপ্রিল নূতনচন্দ্র সিংহকে রেখে তারা সবাই সে চত্বর ত্যাগ করেন। তাদের
সানুনয় অনুরোধেও নূতনবাবু তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং বলেন প্রয়োজনে তিনি তাঁর
মাতৃভূমিতেই মরতে চান যেখানে তিনি দেবী কুণ্ডেশ্বরীর উপাসনালয় স্থাপন করেছেন, নিজ
ভিটেমাটি ছেড়ে তিনি যাবেন না। পরিবারগুলো চলে যাবার পর তিনি সেখানে আবার ফেরত যান,
তখন নূতনবাবু আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন, জিজ্ঞেস করেন তিনিও চলে যাবেন কী’না এবং
অনুরোধ করেন তাঁর সাথে থাকতে। আবেগবিহ্বল হয়ে তিনি নূতনবাবুকে নিশ্চিত করেন যে,
তিনি যাচ্ছেন না। অল্পক্ষণ পর তিনি সেখানে রান্নার লোক গৌরাঙ্গকে দেখতে পান এবং
পরদিন দুপুরে তাঁর ভ্রাত্রৃবধূর বাড়ি জগৎমল্লাপাড়া যান। মধ্যাহ্নভোজ শেষে
কুন্ডেশ্বরীতে ফিরলে নূতনচন্দ্র তাঁকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। ১৩ই এপ্রিল
সকাল ৯টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জিপ কুণ্ডেশ্বরীতে প্রবেশ করে মূল ভবনের
সামনে থামে। কিছু সেনাসদস্য গাড়ি থেকে নামলে সেখানে উপস্থিত সকলেই সালাউদ্দিন
কাদের চৌধুরী ও মাবুদকে সনাক্ত করেন।
এর অল্পক্ষণ পরেই ব্রজহরিসহ তিনি দোতলায় লুকোতে যান আর অন্যরা কাছের জঙ্গলে
আশ্রয় নেয়। ব্রজহরির ঘরের জানালা দিয়ে তিনি ও ব্রজহরি পুরো ঘটনাটি দেখেন।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও সেনাসদস্য নূতনবাবুর সাথে কথা বলে এবং কিছুক্ষণ পর তারা
গাড়ি নিয়ে চলে যায়। তখন তারা দু’জন ভাবেন বিপদ কেটে গেছে। ৮/১০ মিনিট পড় ফের গাড়ির
শব্দ শুনে তারা আবার ওই ঘরেই লুকান। সেখান থেকে দেখতে পানঃ সালাউদ্দিন কাদের
চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে কুণ্ডেশ্বরীর মন্দিরে প্রবেশ করে আর হিঁচড়ে
নূতনবাবুকে মন্দিরেরে সামনে আঙিনায় এনে ফেলে। তারা তাঁকে সরাসরি গুলি করে আর তারপর সালাউদ্দিন চৌধুরী তার আগ্নেয়াস্ত্র থেকে
২/৩ প্রস্থ গুলি ছোঁড়ে। এরপর আততায়ীরা সেস্থান ত্যাগ করে। নূতনবাবু ঘটনাস্থলেই
মারা যান। জেরার সময় তিনি তাঁর মূল সাক্ষ্যের বক্তব্য পুনর্নিশ্চিত করেন। আসামীপক্ষ তাঁর পূর্বোক্ত বক্তব্যের সাথে কোনোরূপ অসামঞ্জস্য খুঁজে পেতে
ব্যর্থ হয়। তিনি আসামীপক্ষের এই বক্তব্য অস্বীকার করেন যে তিনি যেমনটা বর্ণনা
করেছেন তেমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি।
সাক্ষী নং ১ আনিসুজ্জামানও অন্যান্য অধ্যাপকদের সাথে কুণ্ডেশ্বরীতে আশ্রয়
নেয়ার কথা বলেন। এরপর তিনি জানান, ২রা এপ্রিল
তারা সবাই কুণ্ডেশ্বরী ছেড়ে চলে যান। ১০ থেকে ২৬শে এপ্রিল তারা রামগড়ে ছিলেন এবং
সেখানে মধ্য এপ্রিলের কোনো এক সময়ে তাঁর প্রফুল্ল সিংহের সাথে দেখা হয় যিনি তার
বাবার মৃত্যুর খবর তাঁকে জানান। প্রশ্নোত্তরকালে প্রফুল্লের বর্ণনায় জানা যায়,
পাকিস্তানী সেনারা কুণ্ডেশ্বরীতে ঢুকে তার বাবার সাথে কথা বলার সময় সালাউদ্দিন
কাদের চৌধুরীর উসকানিতে তার বাবাকে গুলি করে মারে। প্রফুল্লের ভাষ্যমতে মৃতদেহটি
সেখানে তিনদিন বেওয়ারিশ অবস্থায় পড়ে থাকার পর স্থানীয় লোকেরা তার সৎকার করে। সে
আরও জানায়, নূতনচন্দ্রের সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাকে দু’বার
গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। জেরার সময়ে তিনি তাঁর মূল সাক্ষ্যকালীন বক্তব্য পুনর্নিশ্চিত
করেন। তিনি জানান নূতনবাবুর দুই ছেলে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেয়। তিনি
আসামীপক্ষের এ বক্তব্যকে অস্বীকার করেন যে, তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট
মিটিংয়ে সাক্ষী নং ৮ এর কাছ থেকে তার (সাক্ষী নং ৮) অত্যাচারিত হওয়ার ঘটনা শুনে
মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছেন।
মৌখিক সাক্ষ্যের পাশাপাশি বিচারক আলামত ১৬ এর ওপরও আস্থা প্রকাশ করেন যেটি
ছিলো দৈনিক বাংলা পত্রিকার ১৩ই এপ্রিল ১৯৭২ সংখ্যা। এতে প্রকাশিত খবরটি ছিলো
নিম্নরূপঃ
দেশ স্বাধীন হবার অব্যবহিত পরেই এটি প্রকাশিত হয়।
এতে স্পষ্টভাবে বলা আছে ১৩ই এপ্রিল সালাউদ্দিন পাকবাহিনীসহ কুণ্ডেশ্বরী চত্বরে
প্রবেশ করে এবং তাদেরকে বলে যে, তার বাবার তরফ থেকে নির্দেশ আছে নূতনচন্দ্র ও
ছেলেদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার। নূতনবাবুর ছেলেরা আগেই সে জায়গা ছেড়ে চলে গিয়েছিলো
এবং নূতনচন্দ্র যখন প্রার্থনা করছিলেন সালাউদ্দিন তাঁকে মন্দির থেকে টেনে বের করে
এবং মেজর তিনটি গুলি করেন; তা সত্ত্বেও
সালাউদ্দিন তার দিকে গুলি ছোঁড়ে এতে তিনি নির্মমভাবে খুন হন। খবরে আরও উল্লেখ করা
হয় সালাউদ্দিন ১৯৭২ এ লন্ডনে ছিলো। এই খবরটি হত্যা প্রক্রিয়ার ধরনের ব্যাপারে
বাদীপক্ষের ভাষ্যকে সমর্থন করে, আবার একইসাথে এটি বিবাদীপক্ষের ভাষ্যকেও সমর্থন
করে যেখানে বলা হয়েছে খবরটি প্রকাশিত হওয়ার সময় সালাউদ্দিন ১৯৭২ সালে লন্ডনে ছিলো।
“বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ দলিল-৮ম খণ্ড” এর ৪৬৫
পৃষ্ঠাতেও
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সম্পৃক্ততা
সম্পর্কে অনুরূপ তথ্য লিখিত আছে। দৈনিক আজাদীর
৮,৯, ১৮ এবং ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭০ সংখ্যাগুলোতে এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয় যে, সরকার রাউজানে
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং দুর্বৃত্তরা রাউজান হাটহাজারী
এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত করছে।
প্রকাশিত সংবাদসমূহ আলামত ১৬ এর ভিত্তি আরও জোরদার করে। আলামত ৩২ হলো জি আর রেজিস্টার। এই রেজিস্টারে ২৯শে জানু.৭২ তাঃ রাউজান পিএস মামলা নং ৪১ এ নূতনচন্দ্র
সিংহ হত্যার দিন ১৩ই এপ্রিল ১৯৭১ভোর ৬টা৩০মিঃ এই মর্মে নথিভুক্ত করা হয়। তথ্যদাতা ছিলেন সত্যরঞ্জন সিংহ এবং মামলা ভুক্তি
হয় পেনাল কোডের ৩০২/১২০বি/২৯৮ ধারানুসারে। আসামী নং ২ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পলাতক
হিসেবে দেখানো হয়। আলামত ৩৮–দৈনিক আজাদীর ৮ডিসে/১৯৭০ সংখ্যা, পেপারবুক পর্ব৩ পৃঃ৬৬৩; আলামত৩৮/১-একই সংবাদপত্রের পৃঃ৬৬৫,পর্ব৩;
আলামত৩৮/২-দৈনিক আজাদীর ৯ডিসে/১৯৭০ সংখ্যা পৃঃ৬৬৭,পর্ব৩; আলামত৩৮/৪- দৈনিক আজাদীর ১৪ডিসে/১৯৭০ সংখ্যা
পৃঃ৬৭৫,পর্ব৩; আলামত৩৮/৫- দৈনিক আজাদীর ১৫ডিসে/১৯৭০ সংখ্যা
পৃঃ৬৭৬,পর্ব৩; এই সকল পত্রিকা সংবাদ প্রকাশ
করেছিলো যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার পিতা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে রাউজানে সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার চালায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন