বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

বাবা যখন ছোট





বই পড়তে শেখার ঠিক আগের বয়সটা, খুব আগ্রহোদ্দীপক। 

সেই যে - মলাটের শক্ত বাঁধাই,গুটিগুটি কালো অক্ষর, ছাপাখানার গন্ধ মাখা, চারকোণা একটা জিনিস, যেটা থেকে মা পড়ে শোনায়! ঘুমের আগে, ভাত খাবার সময় - কখনো নির্জন দুপুরে আইস্ক্রিমওয়ালার ডাক থেমে গেলে। 

সেটাকে বই বলে - তখন জানি, কিন্তু পড়তে পারিনা। একটু একটু করে পড়তে শিখছি। মা যেটা পড়তো, বাবাকে রাতে আবার সেই পাতা থেকেই দু’টো চারটে শব্দ শিখে চেঁচিয়ে শুনিয়ে ফোকলা দাঁতে কী হাসি! কখনো বাবার কাছে গিয়ে – ঘাড়ে উঠে, ছোট ছোট হাতে চুল টেনে ধরে – পলে দাও, পলে দাও – বলে আধোবোলে আদর আদায়ের চেষ্টা এ সবকিছুই আমার-আমাদের শৈশবের সুখস্মৃতি হয়ে আছে। ছোটবেলার স্মৃতির সবচাইতে আনন্দময় অংশগুলোর কথা মনে করলে এখন আর দামী খেলনা, সুন্দর জামাকাপড় বা জন্মদিনের বিরাট কেইকের কথা স্মরণ করতে পারিনা। কিন্তু আজো চোখ বুঁজলে অনায়াসে ফিরে যেতে পারি সেই আলোছায়ার নরম বিকেলে, সেগুনবাগিচার উঠোনে- বেতের চেয়ারে চুল খুলে চশমা চোখে মা আর চারপাশে মোড়ায় বসে, গালে হাত দিয়ে, মুখে আঙ্গুল পুরে আমরা। কিন্নর কণ্ঠ, ক্রমাগত পড়ে চলেছে আর একটা একটা করে অজানা রাজ্যের দরজা খুলছে আমাদের সামনে! কী অপূর্ব, কী ভীষণ রোমাঞ্চকর সেই আবিষ্কার! ছোট্ট জীবনে এত্তোকিছু জানবার আছে, এত্তোকিছু ঘটে!! 

আজ বুঝতে পারি, সোনারঙা শৈশবকে সবাই ধরে রাখতে পারেনা। জীবনের জটিলতায় আমরা সবাই আক্রান্ত হই, পঙ্কিলতায় নিমজ্জিতও হই। কিন্তু তারপরেও শৈশবের সোনালি অঞ্জন আমাদের চোখে যে রংধনুর বিস্ফোরণ ঘটায়, সারা জীবনই তাকে একটু একটু করে উপভোগ করি আমরা। জীবনে যখন ভীষণ কঠিন সময় আসে, চারপাশে যখন কিচ্ছু নেই বলে মনে হয়, আশার কোনো আলোই যখন দেখা অসম্ভব হয়ে পড়ে, আধোবোলের নির্ভার শৈশবের কাছে ফিরে যেতে বড্ড ভালো লাগে তখন।

আমার নিজের জীবনের সবচাইতে বড় অর্জন বলে যদি কিছু মনে করে থাকি, সেটা হ’লো আমার বাংলা পড়তে শেখার সময়টা। ভোরবেলায় হকার খবরের কাগজ দিয়ে গেলে সেখান থেকে একটা একটা করে অক্ষর, সেটা থেকে শব্দ, তারপর বাক্য- তারপর পুরো একটা পরিচ্ছদ পড়তে পারা ! টোনা কহিল, টুনি পিঠা বানাও। সেই একটা মাত্র বাক্য কতরকম ভাবে, কত শব্দে,বাক্যে,ঢংয়ে ব’লে ব’লে চারপাশের মানুষের কান ঝালাপালা করে দেওয়া, আর দিগ্বিজয়ী আনন্দে বাড়ী মাথায় করে চেঁচানো- আহ্‌ সুমধুর সোনালি রং ঝলমলে সেইসব দিন! 

ছোটবেলার আনন্দময় স্মৃতিকে কেউ হাতের কড়ায় গুণতে বললে অবধারিত ভাবে আমার ঠোঁটের ডগায় প্রথম যে বইয়ের নামটা চ’লে আসে সেটা অ্যালেক্সান্ডার রাস্কিনের বাবা যখন ছোট। যখন পড়তে পারতাম না, তখন মা-ভাই-বোন-খালা- মামী-চাচীদের অ্যানেকডোটাল রেফারেন্সের প্রাবল্যে এই বইটা আমাদের বাড়িতে জাতীয় সঙ্গীতের মতো জাতীয় বইয়ে পরিণত হয়েছিলো। ভুন্দেরখেন্দ, ভুন্দেরখেন্দ বলে কতো যে পরিহাস সয়েছি ছোট্ট বাবার মতোই, সেই দুঃখের ফিরিস্তি আজ আর না গাই। তারপর – কেউ কি কখনো ভেবেছিলো দেখহ, লিজা পিসির হচ্ছে কী’না বিবাহ – সেই লিজা পিসির জায়গায় কায়দামতো বাড়ির কারুর নাম বসিয়ে ছড়া এবং কিল চড় থাপ্পড়; কুকুরের কামড়ের চোদ্দটা ইনজেকশনের গল্পে আমার আর শম্পার যৌথ বেড়াল পোষার সিদ্ধান্ত, গানের স্যার আসলেই খাটের তলায় লুকনো – হায়! কতশত কাজ যে ওই বইটা পড়ে আমরা করেছি, করার চেষ্টা করেছি, অথবা করে ফেলে গল্প শুনে অবাক হয়ে গেছি কী করে এমন অত্যাশ্চর্য মিল সম্ভব ছোট্ট বাবা আর আমাদের মধ্যে! পৃথিবীর সব দুষ্টু ছেলেমেয়েরাই যে একদিন বড় হয়ে বাবা হয়, আর তাদের ঝুলিতে বলবার মতো এত্তো এত্তো সব গল্প জমা হয় – সেটা বুঝে ওঠবার মতো বয়স তখনো আমাদের হয়নি। 

অনেক অনেক দিন পর, বড় হয়ে, রীতিমতো পাশ টাশ করে জ্ঞানীগুণী হবার পর  :)  দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে হাতে এলো বইটা। অন্তর্জালের কল্যাণেই। কে পিডিএফ করেছে জানিনা, জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া, তাতে কলমের দাগ বসানো, অতি অবশ্যই পুরনো, জরাজীর্ণ পাতাগুলোর অবস্থা। তারপরেও- বাচ্চাদের মতো খুশিতে স্রেফ বি—শা—ল একটা লাফ দিলাম! হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলা, ঝপ্‌ করে, এক নিমেষে আমার চোখের সামনে, বুকের ভেতর, কণ্ঠের নৈকট্যে। পড়ছি আর ছোটবেলার একরাশ স্মৃতি ঝাঁক বেঁধে উড়ছে মাথার চারপাশে। পড়তে পড়তে বুঝতে পারলাম শৈশব কখনো হারায় না। সে বসে থাকে আমাদের মনের গহীন কোনো কুঠুরিতে। জলবাতাস, ভালোবাসা পেলেই সে আবার বের হয়, উঁকিঝুঁকি দেয়। আমাদের সবার মনেই। বইটা পড়তে পড়তে আজকের  বাচ্চাদের কথা ভাবছিলাম। তাদের শৈশব গণকযন্ত্রের বা মুঠোফোনের পর্দায় অনেক বেশি রঙিন, অনেক রোশনাইয়ের ঝলকানিতে বিহ্বল। অন্যগ্রহের উদ্ভট জন্তু থেকে পাশের বাড়ির পোষা কুকুরকে ডিজিটালি মারবার অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতের একটা আঙুলের ছোঁয়ায়। ফার্মভিলে চাষবাস করে স্ট্রবেরি আর ইলেক্ট্রনিক আইসক্রিম বিতরণ করে নেট-বাডিদের সঙ্গ – দুইই লাভ করছে তারা চারকোণা একটা বাক্সে চোখ আটকে রেখে। আমাদের চারকোণা বাক্স থেকে তাদের চারকোণা বাক্সের গড়ন, আদল এমনকী পঠনপাঠনও আলাদা। তারপরেও, আমার ভেতরের যে ছোট্ট বাচ্চাটা আছে, তার হঠাত মনে হলো- যদি সেই সময়কার এই সুন্দর, অতি সাধারণ, অতি মিষ্টি, অতি দুষ্টু বাচ্চাটার সঙ্গে এই সময়কার দুষ্টু মিষ্টি বাচ্চাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেতো, তাহলে কেমন হতো? আমাদের শৈশবটাও যে নেহাত ফেলনা ছিলোনা, সেটা যেমন তারা জানতে পারবে, তেমনি হয়তো এসময়েও জন্ম হতে পারে আরেকটা ছোট্ট বাবার। যে তার বাচ্চার জন্য লিখে রেখে যাবে ঠিক এমনি সুন্দর আর স্মৃতিমেদুর কথামালা। সেই ভাবনা থেকে গল্পগুলো পড়ার চেষ্টা করেছি। একটা অডিওবুক বানানোর চেষ্টা করেছি। সবগুলো গল্প এখনো যোগ হয়নি, আস্তে আস্তে হবে। 
এ গল্পগুলো কারা শুনবে? 

যারা এখন ছোট, তারা। 

যারা একটু একটু করে বাংলা পড়তে শিখছে, তারা।

যারা এখনো পড়তে শেখেনি, কিন্তু গল্প শুনতে ভারি উৎসুক, তারা।

যাদের বাবামা’দের গল্প শোনাবার সময় নেই ব্যস্ততায়, তারা। 

আর তারাও, যারা আমার মতো বড় হয়ে গেছে কিন্তু ছোট্টবেলার সোনালি দিনগুলোকে ফিরে পেতে উৎসুক। 

আরো সবাই- যারা গল্প শুনতে, পড়তে ভালোবাসে। 

নিচের লিঙ্কে গিয়ে সবগুলো গল্প একটা একটা করে শোনা যাবে। আস্তে আস্তে বইয়ের প্রত্যেকটা গল্পই আপলোড করে পূর্ণাঙ্গ একটা অডিও-বই করে ফেলবো।
কেমন লাগলো এই সফর, তা আপনাদের এবং বিশেষ করে বাড়ির খুদে সদস্যদের কাছ থেকে শোনার আগ্রহ রইলো। ভীষণই। হ্যাপি লিসেনিং। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন