রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৩

প্রেমের গল্প লেখার অপচেষ্টা:পর্ব ৩,৪,৫

পর্ব ১,২




সন্ধ্যের পর থেকেই পেটে ব্যথা, মাথা ধরে আছে, গা গুলোচ্ছে । কিছু খেতেও পারেনি স্কুল থেকে ফিরে।

গত প্রায় দু’মাস ধরে ডাক্তার আন্টির কাছে যেতে হচ্ছে, ছোটখাটো মেয়েলি সমস্যার ফিরিস্তি দিতে হচ্ছে, ইনফ্যাক্ট আজও গিয়ে ওইসব কথা আর শরীর বিষয়ক অনেক অনেক অপছন্দের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে একসময় দিশেহারা লাগছিলো তার। চোদ্দ বছর হচ্ছে, কিন্তু বালিকা থেকে নারী হবার লক্ষণগুলো ঠিকঠাকমতো দেখা না যাওয়াতেই মা কিছুদিন হলো কেমন উদ্বিগ্ন। ডাক্তার আন্টির সাথে গত চারটা সেশনে একটু একটু করে জট খুলছে মাথার, কিন্তু লজ্জায় আর আড়ষ্টতায় অনেক কিছুই সে বলতে পারেনা, কেবল মাথা নাড়ে আর হুঁ হ্যাঁ করে। আজ এক পর্যায়ে সাঁড়াশি আক্রমণ মনে হচ্ছিলো তার। শরীরের নিয়ন্ত্রণ তার হাতে নেই, ঠিকমতো খাচ্ছে দাচ্ছে খেলাধূলা করছে, মায়ের বকুনি বাবার শাসন সব গিলেও যতগুলো ওষুধ আন্টি দিয়েছেন চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার আন্টি আজ বলেছেন অবশ্য “যারা রোগা তাদের ওটা হতে একটু দেরী হয়, তুই দু:শ্চিন্তা করিসনা বেশি।”

“ওটা” কী জিনিস সেটা গত তিনটে সেশনে একটু একটু করে প্রকাশিত হয়েছে, আর বারবার তার মনে হয়েছে, “হে ধরণী দ্বিধা হও!” আনিকা, তাবাসসুম, মনি, আফরীন, মাইশাদের দঙ্গলে সে মুখচোরা। ওরা কী ভীষণ দুম করে পটাপট শরীর, রোম্যান্স নিয়ে ঠাট্টা করে। ছেলেদের নিয়ে আলাপ শুরু হলে তার নাক-গাল লাল হয়ে ওঠে, কানের ডগা গরম হয় অস্বঃস্তিতে। কিন্তু এটা তো ডাক্তারের চেম্বার, গুরুগম্ভীর আন্টি একদম কোনো রসিকতা করেন না, ওর ইনেক্সপেরিয়েন্স, ইনোসেন্স, ইম্যাকুলেটনেস নিয়ে ঠাট্টায় নাস্তানাবুদ করে নাক টিপে খ্যাপানও না। টুকটাক প্রশ্নের জবাব দেন, শরীর-মনের ওপর এই বদলানো সময়টার প্রভাব কি হতে পারে সেগুলো বুঝিয়ে বলেন। তারপরেও শরীর বিশেষতঃ মেন্সট্রুয়াল সাইকেল, ওভুল্যুশন এগুলোর কথা শুনলেই ওর কেমন যেন অদ্ভুত লাগে। নিজের শরীর বদলে যাচ্ছে-যাবে এটা কেন যেন মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। বুঝতে পারছে না, কিন্তু ভেতর থেকে কেউ চিৎকার করে উঠে বলতে চায় কিচ্ছু চাইনা, প্লিজ। বন্ধ করো এসব কথা!

আজ ওখান থেকেই অসুস্থ লাগার শুরু, মনে হয় জ্বর আসছিলো, আন্টি একটা ওষুধ দিলেন আর বাড়ি ফিরে ক’দিন রেস্ট নিতে বললেন। বাস্কেটবল খেলে না’কি ওর ওপর খুব ধকল গ্যাছে, ক’দিন ওটা থেকে দূরে থাকার প্রেস্ক্রিপশন!

এমনিতেই ব্যথা তলপেটে, তার ওপর বাস্কেটবল নিষেধাজ্ঞা! অসহ্য লাগছে! রাত এখন ক’টা বাজে কে জানে! নীল রেডিয়াম ঘড়ি গাঢ় বাসন্তীরঙা দেয়ালে। ওহ্‌, পৌনে আটটা মাত্র। পাঁচটায় ফিরে সেই যে কাত, টানা দু’ঘন্টা  ঘুমিয়েছে।

বাথরুমে গিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে হতে আবার তলপেটে ব্যথা তীব্র হয়। আচমকাই টের পায় উষ্ণ রক্তের একটা ধারা পা বেয়ে নীচে নামছে তার! ব্যথায় পেট মুচড়ে উঠছে, মাগো!
মাকে চাই, এক্ষুণি!

কোনোরকমে জামা বদলে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মা’র ঘরের দিকে পা বাড়াতেই বুয়া খবর দেয় মেহমান এসেছে, মা ড্রইংরুমে।
আবারও অসহ্য লাগে তার!

এইসময় কে এসেছে! কী দরকার! অসহ্য, অসহ্য, অসহ্য!
ড্রইংরুমের পর্দার ফাঁক দিয়ে বেশ উচচস্বরে হাসিগল্পের আওয়াজ ভেসে আসছে।

বাবা মা দু’জনেই ওখানে। কঙ্কাটাও মা’র কোলে বসে, সে আড়চোখে দ্যাখে পর্দার ফাঁক দিয়ে।

ওদিকে চুনি খালাওহ, পান্না খালা, খালুও আছে... আর এমি... আর... ওটা... ওটা কে?

গলার কাছটা জ্বরে তেতো, বমি আসছে পেট উল্টিয়ে, তলপেটে ব্যথার কামড়, তারপরেও-

তারপরেও...

দু’মাস আগের জমাটবাঁধা গ্রীষ্ম দুপুরের ওই ছ’ফিট লম্বা-তীব্র চোখ-কপালে এলোমেলো চুল- লোকটাকে একনজর দেখেই মনে পড়ে যায় ওর।

ইস্‌, মা কি করেই না ধরেছিলো আর সমুদা(হ্যাঁ সমুদাই তো, মা বারবার করে বলে দিয়েছে সমুদা ডাকতে) কত্তোভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে না পেরে শেষটায় রাজি হলো! যদিও পড়ানোটা শুরু হয়নি ওর ক্লাসকোচিং আর সমুদার জি আর ই না কি যেন পরীক্ষার জন্যে। মাসখানিকের মধ্যেই যাবে ও, পেইন্টিং আর পিয়ানোর কোনো একটাকে বাদ দিয়ে ক’মাসের জন্য।

সেদিন প্রথম ধরা পড়ে যাওয়ায় ভয় পেয়ে বোঁ করে ঘুরে দাঁড়ানো মনে পড়ে যায়। আরও মনে পড়ে ওই লোকটাকে দেখে কী যেন হয়ে যাচ্ছিলো ভেতরে! কাউকে বলা যায়না, বোঝানোও যায়না। তাই দৃষ্টিসীমার ওপারে যাবার আগেই নির্নিমেষ যতটা দেখে নেওয়া যায়...
সেদিন ছিলো ভয়, আজ হ’লো রাগ।

বিষম রাগ।

কেন? ঠিক এই সময়ে, এমন করে মা’কে বেঁধে রেখেছে ওরা? ওই লোকটা এখন কেন মা’র সাথে? এখন মা শুধু ওর হবার কথা ছিলো! এখন চাইলেও ডাকতে পারবে না চেঁচিয়ে। চাইলেও কোলে মাথা রেখে শুতে পারবেনা। চাইলেও মা আলতো করে পেটে হাত বুলিয়ে দেবে না! কেন এসেছে ও? এখন? এই বিচ্ছিরি সময়ে?

একটা নাম না জানা অভিমান।

গলা পর্যন্ত বুঁজে আসা কষ্ট।

শরীরের সাথে মনের ব্যথার জমাট বাঁধা ক্লেদ।

“আমি মরে যাচ্ছি মা, প্লিজ!! ব্যথায় অসহ্য লাগছে, ওই লোকটা কেন ওখানে, তোমার পাশে?
তোমাকে ঠিক এখন ও কেন কেড়ে নিলো?”

দু’চোখে জল, স্ফীত নাসারন্ধ্র, উরুর কাছটা গরম, নিঃশ্বাসের হল্‌কাতে ঠোঁট পুড়ে যাবার মতো জ্বালা করে ওঠে।

টলতে টলতে নিজের ঘরে ফেরে সে। কোনোক্রমে বিছানায় পড়ে। কাঁথা টেনে মুড়ি দিতে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

জ্বর আসছে। কাঁপুনি দিয়ে।

তারপরও অদ্ভুতভাবে চোখ বুঁজলেই মনে পড়ে তীক্ষ্ণ চোখ, ঠোঁটে মুচকি হাসি আর “বয়সের তুলনায় ওকে তো ছোট্ট লাগছে...”
জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হতে হতে “বড়” হয়ে যাওয়া কুশি ছটফট করে, মেয়ে হয়ে ওঠার যন্ত্রণায়।



“হ্যাঁ টোয়াইস পাই আর আর পাই আর স্কয়্যারের ডিফারেন্সটাতো সেদিনই কভার করেছি, তুই আজকে সিলিন্ডারের ভলিউমের অঙ্কগুলো কর তারপরে প্যারাবোলার দু’টো কন্সেপ্ট আর ফিজিক্স এর লাইটের চ্যাপটারের জাস্ট চারটা অঙ্ক করাবো। ব্যাস, দেখবি অনেক ক্লিয়ার হয়ে গ্যাছে মাথা, পারবি না?”

ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ে কুশি। গত তিনমাসে আসলেই সমুদা অনেক চটপট তিন চারটে বিষয় এক্কেবারে আন্ডার দ্য গ্রিপ করতে খুব সাহায্য করছে। মাঝেমাঝে নিজেই অবাক হয়ে যায়, কি করে এতো অল্প সময়ে ও এতো কিছু নিতে পারছে! সমুদা পড়ায় খুব ভালো, আর আগ্রহটা জাগিয়ে তোলে খুব দ্রুত। চট্‌ করে দুর্বলতার জায়গাগুলো ধরে নিয়ে সুন্দর উদাহরণ দিয়ে হাতে কলমে ধরে প্রবলেমগুলো সল্‌ভ করিয়ে দ্যায়। এতো ভালো টিচার এ পর্যন্ত পায়নি ও। কিন্তু সমস্যা একটাই। ভীষণ ভয় পায় ও লোকটাকে। 

ভীষণই।

কেন, আজও বুঝে উঠতে পারেনি।

পড়ানোর সময় খুব কম কথা বলে কুশি। ইচ্ছে করেই। খুব জটিল কোনো কেমিস্ট্রি ইকুয়েশন বা ত্রিকোণমিতির সাইক্লিক অর্ডারের অঙ্ক না মিললে সমুদার মুখ যখন কঠিন হয়ে যায়, তখন বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হয় তার। সমুদা বকা দেয়না ততোটা, কিন্তু অমনোযোগ একেবারে সহ্য করতে পারেনা। এমনভাবে তাকায়! ভ্রু কুঁচকে, বিরক্তির বলিরেখায় কপাল ভরিয়ে, “চারবার একই ভুল আর সিলি মিসটেইক...দশটা অঙ্ক করেছি আমরা কালকেই...তোর কাছ থেকে এটা এক্সপেক্ট করিনা, কুশি! শেইম!” কুশির নাক-কান-গাল রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। মুখ নিচু, অজ্ঞতা আড়ালের চেষ্টা, একবার মনে হয় মাটির সাথে মিশে যায়!

“নে আবার কর, দ্যাখ চিন্তা না করে মাইনাসকে এই লাইনে প্লাস বানিয়েছিস...” ভুলটা এতো তুচ্ছ! ধরা পড়াতে ফের লজ্জা পায়। তড়িঘড়ি ভুল ঠিক করে, ফিজিক্স আর ডায়নামিক্স পড়ার সময়ও অস্বঃস্তি কাটেনা।“সমুদা কী ভাবছে আমাকে?আমি একটা স্টুপিড। আজকে ক্লাসেও এই অঙ্কটা শুধু অর্ণব ভাইয়ার ফর্মুলা ফলো করে ভুল করে এসেছি। কী স্টুপিড আমি, কী স্টুপিড!”
হঠাত অর্ণবের কথা মনে আসাতে আজকে ব্যাগের মধ্যে দেওয়া চকোলেট গিফটটার কথা মনে পড়ে, আরো মনে পড়ে আফরিনের আগাথা ক্রিস্টির বইটা, ওটাতে চকোলেট লেগে গেলে আফরিন পেত্নি খুন করবে ওকে... অর্ণব ভাইয়া চকোলেটের সাথে একটা কার্ডও দিয়েছে। বলেছে ওটা নিজে গ্রাফিক্স সফটওয়্যার দিয়ে বানিয়েছে...ইস্‌স্‌ দেখা হয়নি...

এই অমনোযোগ চোখ এড়ায় না সামিনের। মেয়েটার কি হয়েছে আজ!বারবার চোখ এদিক ওদিক, সোজা অঙ্ক ভুল করলো, এখন থিয়োরি যতটা পারে ইন্টারেস্টিং করেই পড়াতে চেষ্টা করছে... কিন্তু বাচ্চাটা্র... আই মিন মেয়েটার(কী হচ্ছে ফাজলামি? আবার এই পুঁচকে মেয়ে আর বাচ্চার কলিশন শুরু হ’লো মাথার মধ্যে, উফ্‌ফ্‌!)বারবার ব্যাগের দিকে তাকানো, কিছু খোঁজা... অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া...

অন্যদিন এক দু’বার মৃদু বকা দিলেই ভয়ে নড়েচড়ে বসে, কিন্তু আজ পুরো হরিণছানার চাঞ্চল্য তার হাবেভাবে। ব্যাপারটা কি?

একটু বেশি কঠোর হবার ফন্দি আঁটে। মুখ যথাসম্ভব গম্ভীর করে আলগোছে পেন্সিল বক্সের পাশে থাকা রুলারটা তুলে নেয় হাতে।
কুশির তখনো খেয়াল নেই, লেকচার শোনার অবকাশে পা দিয়ে ব্যাগটা ঠেলছে, হাতের নাগালে চলে এলো... মাথা নিচু করে চেইন খুলে চকোলেটটা ঠিক আছে কি’না দেখতে যাবে...

আচম্বিতে – ঠাস্‌!

রুলারের বাড়ি কাঠের টেবিলের ওপর! সজোরে!

মুহুর্তে শ্বাস বন্ধ কুশির।

আতঙ্ক গ্রাস করে কৈশোরের সারল্যমাখা মুখ।

“কি হচ্ছে তখন থেকে? আমি দু’বার বললাম, তিনবার বললাম... এটা কি পড়াশোনা না ফাজলামির টাইম?”

“মনোযোগ কোথায় তোমার?” খুব রেগে গেলেই শুধু সমুদা তুমি করে বলে!

“আমার সময় এবং তোমার পড়াশোনা দুটোরই দাম আছে। ফাজলামি করার জন্য আর বারেবারে ইতিউতি চাওয়ার জন্য আইভী খালা তোমাকে রোজ এখানে পাঠাচ্ছেন না। আজ তুমি তোমার হরলিক্সটা পর্যন্ত খাওনি। হোমটাস্কগুলো করে আনোনি,সিলি মিস্টেইক করছো, কথায় কথায় অন্যমনস্ক হচ্ছো। কি, ব্যাপারটা কি?”

“ক্‌-ক্‌...কিছুনা, সমুদা, আমি আসলে টায়ার্ড একটু..তাই...”কাঁপা কণ্ঠে কুশি দুর্বলভাবে বলতে চেষ্টা করে।

“টায়ার্ড হ’লে পড়তে এলে কেনো? বাসায় একটা ফোন করে দিতে, রেস্ট নিতে, ভালো করে একটা ঘুম দিতে? আমিও আমার জরুরী এডমিশনের কাজ অনেকটা এগিয়ে রাখতে পারতাম।”

“ইয়ে... মানে... আজকে বাস্কেটবল কোর্টে অনেকক্ষণ...”

“কুশি, এটা তোমার খুব ক্রুশিয়াল ইয়ার, আমারও। তুমি কি ফাজলামি করছো আমার সাথে? বাস্কেটবল কোর্টে সময় নষ্টের মাশুল আমার ওপর দিয়ে তোলা কেন?”হিংস্র আর ক্ষুব্ধ কন্ঠস্বর আরও আতঙ্কিত করে তোলে চোদ্দ বছরের সদ্য বড় হতে শুরু করা মেয়েটিকে।

“সমুদাঅর্ণব ভাইয়া ... চকোলেট... ব্যাগে...গলে যাবে...” আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা। গলা কাঁপছে। সামনের দুর্দান্ত পুরুষটির রাগী রূপ তাকে কিঞ্চিত দিশেহারা করে দেয়। অন্যদিকে কৈশোরের সদ্যলব্ধ স্বাধীন সত্তা এতো কিছুর মধ্যেও বেরিয়ে আসতে চায়। কি করতে হবে, কি বলতে হবে-এসব বিষয়ে সেই সত্তা পুরোই অজ্ঞ।

অর্ণব বা এই জাতীয় নামটা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো সামিনের। দুম্‌ করে বলে বসলোঃ “হাত পাতো!”

কুশির মুখ সাদা হতে শুরু করেছে। কোনদিন যেটা স্বপ্নেও ঘটেনি সেটা ঘটবে? এখন? লোকটা... মারবে? ওকে?

মাথা পুরো ফাঁকা, বুদ্ধি এলিয়ে যায়- “সমুদা...আমি...আমি...মানে, আপনি...”

“হাত পাততে বলেছি, হাত পাতো! অবাধ্যতা আমি একদম পছন্দ করি না” চাপা হিসহিসে গলার স্বর সামিনের। নিজের কাছেই অচেনা ঠেকে এই উষ্মা। কিন্তু ভেতরে দহন হচ্ছে, কোথাও। খুব তীব্র। মাথায় আগুন চড়ে গেছে তার।

বিস্ফারিত চোখ, কান্না আর ভয়ের মিশেলে মুখ একটুখানিক হাঁ – বাহু বাড়িয়ে দেয়।

চিকন লম্বা হাত, লতার মতো আঙুল আর গোলাপিরঙা তালু... গমরঙা হাতের মণিবন্ধে একটা গাঢ় লাল ব্যান্ডের ঘড়ি। ডায়ালে রক্তলাল সূর্য ঘিরে টিকটিক টিকটিক – কাঁটা ঘুরছে –সামিনের হঠাত ঘোর লেগে যায়। কনুই থেকে কব্জি, কব্জি থেকে হাতের তালু, কাঁপন দেখে সে। এতো নরম, পাখির পালক ছোঁয়ানো মসৃণ! সোনালি আভা, কাঁপছে, থিরথির...

কিন্তু সেটা মুহূর্তের জন্যই।

আচম্বিতে রুলার নামিয়ে আনে হাতের তালুতে। শব্দটা হঠাৎ এত জোরে আছড়ে পড়ে, নিজের কানেই বিস্ফোরক শোনায়!

সরু আর্তচিৎকার বেরিয়ে আসে কুশির গলা চিরে। অন্য হাত দিয়ে তালু চেপে ধরে, চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। যন্ত্রণা, জ্বলুনি, অপমানে ছটফটিয়ে ওঠে, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে যেয়েও ব্যথায় কুঁকড়ে যায়।

সামিন সম্বিত ফিরে পেয়েছে। জোর করে কুশির বাহু আঁকড়ে ধরে অন্য হাতের বাঁধন খোলে, চেপে চেয়ারে বসিয়ে দেয়-“চুপ! বলেছি না অবাধ্যতা করবে না।” গলা এখনো চাপা, কিন্তু তাতে বিরক্তিমেশা অনুতাপ। চাপা ফোঁপানি, দরদর করে জল গড়াচ্ছে দু’চোখে- কুশি একেবেঁকে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে। সামিনের সাথে গায়ের জোরে সে পেরে ওঠেনা। একরকম চেপে ধরেই সামিন তার দু’হাত নিজের সবল বাহুবন্ধনে আটকায়। তারপর হাতের তালু খুলতে বাধ্য করে।
নিজের কাছে অবিশ্বাস্য লাগে দৃশ্যটা।

গোলাপি হাতের তালু গাঢ় গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে। হাতের মাঝ বরাবর চিকণ একটা রেখা, সেটা লাল... গভীর লাল হচ্ছে। চোখের সামনে রেখাটা ফুটে ওঠে।

টুপ করে একফোঁটা রক্ত সামিনের হাতের তালুতে।

তারপর আরেক ফোঁটা... আরেক ফোঁটা...

লজ্জার থেকেও বিস্ময় বেশি আচ্ছন্ন করে তার কণ্ঠ “ইস্‌, অনেকটা কেটে গ্যাছে! ছিঃ, এটা আমি কী করলাম!! কুশি, তোর লেগেছে খুব, না?”

কুশি বাক্‌রুদ্ধ! অনেকক্ষণ থেকেই। সমুদার লোহার মত শক্ত দু’টোহাত আটকে রেখেছে তাকে... ব্যথাটা জ্বলুনি হয়ে এখন রীতিমতো দপ্‌দপ্‌ করছে বিছুটি জ্বালা নিয়ে। হাতটা সরিয়ে নিতে চায়, পারেনা।
ফোঁপানি উচ্চতর হয়। ভয়, দুঃখ, রাগ, অভিমান সব টুকরো হয়ে ঝরে পড়ছে, চোখ দিয়ে...কোনোভাবেই আটকাতে পারছে না... লজ্জা...কী ভীষণ খারাপ লাগছে...কী ভীষণ কষ্ট...

“কুশি,” গলা অস্বাভাবিক ভারী আর আশ্চর্যজনক নরম সামিনের।
“আমি স্যরি রে... বুঝতে পারিনি...মাথাটা হঠাত ধাঁ করে গরম হয়ে গেলো...চল্‌ বাথরুমে চল্‌... অষুধ দিয়ে লিকোপ্লাস্ট লাগিয়ে দেবো...” সামিনের গলার স্বর বুঁজে আসে। কেন যেন, মেয়েটার জন্য ভীষণ মায়া লাগছে। ছোট্ট বাচ্চার মতো অনেক অনেক আদর করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।

চোখের জলে মাখামাখি মুখটা টিস্যু পেপার দিয়ে আলতো করে মুছে দেয় সে। তারপর দুই বেণী কাঁধের পেছনে আলতো করে ঠেলে দেয়, টের পায় কেঁপে উঠছে মেয়ে, তার হাতের নিচে! ভয়?

চোখের দিকে তাকিয়ে শিকারীর ফাঁদে আটকা পড়া হরিণের আতঙ্ক দ্যখে সে। 

ভালো লাগেনা।

কিচ্ছু ভালো লাগেনা।

কী করলো এটা সে জানোয়ারের মতো? বাচ্চা একটা মেয়ের ওপরে ইগো ফলানো, কি ধরনের ছোটোলোকি?
ঝুঁকে পড়ে আল্‌তো করে কপালের পাশের চুলগুলো সরিয়ে দেয় কুশির, সিঁথির ঠিক মাঝখানটায় ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলে,“তোকে আর কখনো এরকম করে মারবোনা, ব্যথা দেবোনা রে বাচ্চা! ছোট্ট মানুষ, ভয় পাস্‌ না আমাকে। ঘেন্না করিস্‌ না...”
কুশির চোখ বন্ধ।

বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক শব্দ।

হাত জ্বলে, জোরালো টানের ফলে ব্যথাও করে, সেগুলো ছাপিয়েও কেন শুধু বুক ধুকপুক ধুকপুক করছে?

এরকম অদ্ভুত লাগছে কেন?

কেন?



সদ্য ঘুম ভেঙেছে, কী একটা স্বপ্ন দেখছিলো শেষরাতে। পুরোটা মনে নেই, শুধু আবছায়াটুকু ঘুরে ঘুরে যায়...

সামিন কেমন আচ্ছন্ন।

বেডসাইড টেবিলের অ্যালার্ম ক্লকে ছ’টা পনেরো। এতো ভোরে ঘুম ভাঙেনা সচরাচর।

গত ক’টা দিন কেমন তরতরিয়ে কাটছে। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়তে গিয়েও সিদ্ধান্ত নেয় আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার। বালিশটা বুকে চেপে স্বপ্নের টুক্‌রোগুলোকে ফের জোড়া লাগাবার চেষ্টা করে।
জি আর ই র ফল অপ্রত্যাশিত ভালো হয়েছে। এত বেশি ভালো তার নিজের কল্পনাতেও ছিলো না।

আইভি লিগ তো বটেই, শীর্ষ ১০০ ইউনির একটাতে যাওয়া ক’দিন আগেও ছিলো অধরা স্বপ্ন, আজ সেটা হাতের মুঠোর বাস্তবতা। বায়োলজি পড়ার ইচ্ছেটা কোনো কালেই হালে পানি পায়নি, মূলতঃ দেশে সুযোগ না থাকায় আর তার মতো রেজাল্ট নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং এর যেকোন ফ্যাকালটিতে না পড়া একরকমের পাপ- বাবার এ ধরনের ছেলেমানুষি জেদ এ। ছবি আঁকার ঝোঁকটা ছিলো তাই আর্কিটেকচারে ক্লাস করছিলো, কিন্তু জেনেটিক্স এর টুকিটাকি, মলিকুলার বায়োলজি, বায়োইনফরমেটিক্স এর কাজ, এমনকি শুধু বিবর্তন নিয়েও এ-তো কাজ করা যায়, এগুলো ভাবতে গিয়ে তার শিহরণ হ’তো।

নিজের ইচ্ছে, খুব কাছের কিছু বন্ধুর উৎসাহ আর মা’র প্রশ্রয়ে জি আর ই দেয়াটা শাপে বর হয়েছে একদিক থেকে। বাবার ফার্মে বসার ইচ্ছে নেই, কিন্তু রাশভারী মানুষটার প্রবল ব্যক্তিত্বের কাছে তার যৌবনের রোম্যান্টিক স্বপ্ন হালে পানি পায়নি।

বাবা একটা কথা অবশ্য বলেছিলেন।

নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে, যেকোনো ফিল্ডে যাও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আন্ডারগ্র্যাডের মাঝপথে শুধুমাত্র “ভাল লাগছে না”বলে কোনো কিছু ছেড়ে দিলে তার ফল তোমাকেই ভোগ করতে হবে। সেদিক থেকে এই রেজাল্ট আর কালকে হাতে আসা চিঠিটা তার বন্ধনমুক্তির ইশারা। কাত হয়ে শোয়া অবস্থায় হাত বাড়িয়ে বেডসাইড ড্রয়ার থেকে চিঠিটা বের করে আবার। এমআইটির রোবোটিক লোগোটা, মলিকুলার বায়োলজি, আন্ডারগ্র্যাড রিসার্চ, ফাংকশনাল ইন্টারপ্রিটেশন অফ জেনোম ইউজিং বায়োলজিক্যাল নেটওয়ার্ক...... শব্দগুলো কেমন একটা অজানা শিহরণ জাগায় ভেতরে। অচেনা, অজানা এক বিশ্বকে একটা ছোট্ট চিঠি একলহমায় কেমন করে চোখের সামনে, তাদের বাগানঘেরা ছিমছাম বাড়ীর দো’তলা বারান্দায় এনে দিতে পারে, ভেবে সে বিস্মিত হয়।
বিস্ময়ের ভাবনায় মনে পড়ে কাল রাতের পার্টির কথা।

চলে যাচ্ছে, আবার কতো বছর পর দেখা হয় কি’না হয়- স—ব বন্ধুরা মিলে হৈ-হুল্লোড়, নাচগান, কবিতা কৌতুক আড্ডা- খুব দারূণ কিছু মুহূর্ত কাটছিলো। সাব্বিরটার অ্যানেকডোটাল ফাজলামি, সিঁথির লবণ দেওয়া কথাবার্তা, অনেকদিন পর সত্যি সত্যি রিল্যাক্সড লাগছিলো। বাবামা খালা খালুরা নিচে ছিলো। ওরা সবাই ছাদে। যদিও সে নিয়মিত মদ্যপানের অভ্যাস করেনি, বাড়িতে মায়ের এ নিয়ে খুঁতখুঁতানি আছে তাও সে জানে। বাবা কাল কেন যেন বেশ উদার হয়েছিলো। “আর্লি টুয়েন্টিজ, এবার আঁচলের তল ছাড়াও পান্না, ওতো উড়বেই এখন থেকে” বলে কম এল্কোহল স্ট্রেংথের কয়েকটা বোতল অনায়াসেই দিয়ে দিয়েছিলো হাসতে হাসতে।
খু-ব অবাক হয়েছিলো। বাবা শেষ পর্যন্ত তার অ্যাডাল্টহুডটা মেনে নিতে পারছে দেখে।
আনমনে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে সিঁড়িবারান্দা পার হচ্ছিলো সে, আর মালেক ভাইকে খুঁজছিলো।ওপরে কিছু গ্লাস,বরফ এগুলো দিয়ে আসার জন্য।

হঠাৎ চোখে পড়ে বারান্দার এক কোণে রেলিঙে গাল ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে আছে কুশি। তার ফুরফুরে মেজাজের জন্যই হোক, কি সদ্যলব্ধ মদের বোতলগুলোর জন্যই হোক, কুশির ঘনঘোর বর্ষার মতো অন্ধকার মুখ, বিষণ্ণ ভঙ্গী তার চোখ এড়িয়ে যায়।বরং তার চোখের সামনে প্রস্ফুটিত হয় পদ্মের ডাঁটার মতো একটা সতেজ দেহ। আজকে নীল রঙের শাড়ী পরেছে, চুলগুলো রোজকার বাচ্চাদের বেণীতে আটকানো নেই, তার বদলে একঢাল মেঘ হয়ে পিঠের ওপরে ছড়ানো। সামিনের মা জোর করে হলদে রঙের একটা চন্দ্রমল্লিকা বাগান থেকে গুঁজে দিয়েছেন কানের পাশে... বড়রা অনেকেই খ্যাপাচ্ছিলেন ওকে সুন্দরী-রূপসী, ছেলেদের মাথা খাবি এবার বলে... ঠোঁটে চোখে রঙ তৃণা আপি এখানে আসার পর করে দিয়েছে... মা শাড়ি ব্লাউজের পিন সব ঠিকঠাক করে একেবারে ফিটফাট ইয়াং লেডি বানিয়ে দিয়েছে তাকে।

কুশির সবচাইতে বড় গুণ বোধ করি নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে অজ্ঞতা। এই অমনোযোগ তাকে এতোটা মিষ্টি করে তোলে যে বড়রা সেই মিষ্টত্বের স্বাদ নেবার জন্যই ওকে মাঝে মাঝে বোকা বানাতে চান। সব বড়রা স্নেহ আর বাৎসল্যেই এমনটা করেন তা না। আজ কিছুক্ষণ আগে সামিনের বাবার একজন খুব কাছের বন্ধু খুব আলগোছে তার বুক চেপে ধরেছিলেন। সে অবিশ্বাসে আর আতঙ্কে পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করাতে সে ভদ্রলোকটি পেছন থেকে তার কোমরের নিচে চাপ দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে রেখেছিলেন, আর একই সাথে বুক হাতড়াচ্ছিলেন। কি খোঁজার আশায় কে জানে! কুশির দমবন্ধ হয়ে আসছিলো।

সে মুখচোরা, কাউকে কিছু বলতে পারেনা, চিৎকার করা তার ধাতে নেই আর পান্না খালার বাসায় এতগুলো মানুষের সামনে সিন ক্রিয়েট কিছুতেই করতে পারবেনা সেইটুকু বোঝার মতো বড় সে হয়েছে। কিন্তু জীবনে প্রথমবারের মতো এই স্পর্শ তাকে হকচকিয়ে দেয়।

গতকাল তার জন্মদিন ছিলো। চোদ্দ বছরে পা দেবার উদ্‌যাপনে সামিনের আসার প্রশ্নই ওঠনা, সে হাওয়ায় ভাসছে তার জি আর ই আর আসন্ন বিদেশযাত্রার সুখস্বপ্নে। মা আর চুনি খালার চাপাচাপিতেই কেক নিয়ে এ বাড়িতে দাওয়াতে আসা। সে জানে সমুদা খুব ভালো করেছে, চলে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। কেকটা যতটা না তার টিনেইজ ব্লেসিং তার থেকেও অনেক বেশি সমুদার সাকসেস সেলিব্রেশন সেটা মা আর খালার পরিতৃপ্ত মুখ দেখে সে আন্দাজ করেছে। কিন্তু তারপরেও তার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিলো সমুদা তার সাথে দু’টো কথা বলবে, একা। কিছুটা গুরুত্ব দিয়ে।

গতকাল স্কুলে টেস্ট এর রেজাল্ট দিয়েছে। ফিজিক্স, ম্যাথস, স্ট্যাটস তিনটেতেই সে টপ মার্ক পেয়েছে। সবচাইতে বড় কথা হ’লো সারা স্কুলের রেকর্ড মার্ক্স পাওয়া দু’টি মেয়ের মধ্যে সে একজন। সেই চিঠি সে মা’কেও দেখায়নি। বাবকেও না। অর্ণব-আনিকা কাউকেই না। হাতের তালুতে সরু কালচে রেখাটার দিকে তাকিয়ে সে প্রথম যার কথা ভেবেছিলো সে সামিন।

হাতের ব্যথাটা শুকিয়ে গেলেও মনের ঘা এখনো অনেক টাটকা। ওই ঘটনার পর সামিনের আচরণ অবশ্য বদলে গিয়েছিলো অনেকটা। পড়ালেখার বাইরে কদাচিৎ কথা বলতো অন্যবিষয়ে। খুব যত্ন করে এক্সট্রা টাইম নিয়ে পড়াতো পরীক্ষার আগে। হয়তো অপরাধবোধ থেকেই।

আজ তার সাজ, নিজের রেজাল্ট, কেকের টুকরো এগুলো সবই যুদ্ধজয়ের ঘোষণার মতো ছেলেমানুষি আবেগে সে করে ফেলেছে। তাকে মারা হয়েছিলো অন্যায়ভাবে, সামিন তাকে মানুষ হিসেবে একটুও গুরুত্ব দেয়না, ছোট্ট কঙ্কার মতো অ্যাটেনশন সিকিং একটা ট্রাবলসাম টিনএইজার ভাবে- এটা তার সদ্য কৈশোর-আশু যৌবনের পদধ্বনিকে উপেক্ষা করার মতোই বলে সে ভেতরে ভেতরে বিস্ফোরিত হচ্ছিলো।

সেসময়কার চিন্তাভাবনার ঘোর আচমকাই এক প্রৌঢ়ের যৌনকাতরতায় লুণ্ঠিত হবে, এই আবিষ্কার তার কাছে যেমনি বিস্ময়ের, তেমনি অনভিপ্রেত। কোনক্রমে নিজেকে ছাড়িয়ে সে দৌড়ে বারান্দার এক কোণায় চলে এসেছে- অনেকক্ষণ হয়। এখান থেকে বসে বসে ওপরতলার ছাদের হৈচৈ আনন্দের আওয়াজ পায়, যদিও সামিন বিকেলেই তার মাথায় চাঁটি মেরে বলছে, এটা বড়দের পার্টি, ছোটরা নিচে বাবামাদের সাথে থাকবে। আর গার্ডেনের পেছনে দোলনায় দোল খেতে পারিস।

ওপরে যাওয়ার অনুমতি নেই, বড়দের সাথে বসে থাকতে ভালো লাগছেনা, অসভ্য একটা লোক কেমন করে ধরেছিলো ওকে, চারপাশে  গুমোট গরম- সব মিলিয়ে আষাঢ়ের মেঘ ভর করে মুখে।

ঠিক এমনি সময়ে সামিন আবিষ্কার করে কুশিকে।

“কীরে, একা এরকম জম্বি হয়ে বসে আছিস কেনো? ঘরে যা!”
“আমার কিছু ভালো লাগছে না সমুদা।” কাতর কণ্ঠে কুশি জানায়।
“আমি একটু একা বসে থাকি?”
“আপনি তো বলে দিয়েছেন ওপরে যাওয়া আমার অ্যালাউড না, নিচে বাচ্চাগুলো বড় ঝামেলা করছে আর বাবামা’র ঘরে বসে থাকতে আমার দম আটকানো লাগছে! আমার কিচ্ছু ভাল্লাগছেনা সমুদা। আমি প্লিজ একটু এখানটায় বসি? আমি কিচ্ছু করবো না, কারুর সাথে কথা বলবো না। আমি আছি সেটাই জানতে দেবোনা। আমি...আমার...” বলতে বলতে কুশির গলা বুঁজে আসে, চোখের জল দরদর করে কেন পড়তে থাকে সে নিজেই জানেনা!

সামিন হাল্কা মুডে ছিলো, কুশিকে কাঁদতে দেখে সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে।
“এই মেয়ে!” কুশির হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়-“কেন বোকার মতো ভেউভেউ করে কাঁদছিস? কী, হয়েছেটা কী? মন এত্ত খারাপ? বোকা একটা! চল্‌, ঘরে চল্‌। তোর জন্য নতুন একটা বাস্কেটবলের জার্সি কিনেছি, দেখাবো।”

সেই স্পর্শের মধ্যে কিছু একটা ছিলো।কিছু একটা মায়া।

দুঃখ আর অপমানের ভেতরেও সেই মায়ায় গ’লে কুশি।

হাত ধরে ঘরের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে এক্কেবারে সামিনের বুকের ওপর পড়ে।

চোদ্দ আর চব্বিশের প্রথম আলিঙ্গন ঘটে আচমকা, অপ্রস্তুত এবং অপ্রত্যাশায়!

শাড়ি পায়ে জড়িয়ে গেছে, বেসামাল চুল, ঠোঁট অভিমানে কাঁপছে থিরথির, পুরো শরীর সামিনের হাতের বেষ্টনীতে-এমন অবস্থায় কুশি অস্ফুটে বলে,“আপনি চলে গেলে ওই লোকটা যদি আমাকে আবার ধরে?আমাকে...বিশ্রি করে...আমি কি করে..কেন...চলে যাচ্ছেন?”
জলমগ্ন চোখ, জোরালো শ্বাস,এই সুতন্বী কিশোরীর নিঃশ্বাসের ছোঁয়ার বুকের কাছটা উষ্ণ হয়ে উঠেছে তার- সেই নিঃশ্বাসে কিছুটা কি দীর্ঘশ্বাসেরও ছোঁয়া?
কেউ একটা, কুশির সাথে, খুব কুতসিত কিছু একটা করেছে।
মেয়েটাকে জোরে আঁকড়ে ধরে সে। বুকের ভেতর চেপে।কেন, সে নিজেও জানেনা!
“কুশি”,নিজের অজান্তেই গলা নরম আর নিচু,“তোর সাথে...কেউ...কখনো...কিচ্ছু খারাপ করতে পারবেনা।কিচ্ছু না!আই প্রমিস!”
“আমি জানিনা তোকে কে আজ কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু জানবো। ওই লোকটাকে আমি জন্মের মতো শাস্তি দেবো। তুই...তুই... শুধু একটু শক্ত থাক্‌।”
“তুই বড্ড নরম রে কুশি। নরম আর অভিমানী। আর এখনো অনেক বাচ্চা”, আনমনে ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে মাথাটাকে নিজের মুখের কাছে টেনে আনে সামিন। কুশির অবাক, টলটলে মুক্তোবিন্দুর মত অশ্রুদানা ডানহাতের তর্জনীতে মুছে দেয়,“মাত্র চোদ্দ বছর।”নিজের অজান্তেই প্রাপ্তবয়স্কসুলভ হাসি তীক্ষ্ণ ঠোঁটের কোণে-“তোর বড় হবার এখনও অনেকটা পথ বাকী।অ-নে-ক-টা! আমি থাকলে নিশ্চয়ই তোর জন্য সহজ হ’তো। কিন্তু কঠিনও হ’তো। অনেক সময়েই। আমি যাচ্ছি। কিন্তু আমি ফিরে আসবো। তদ্দিনে তুই আশা করছি বড় হবি। ম্যাচিওর্ড হবি।”
“অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শিখবি। লজ্জায়, ভয়ে সবসময় কুঁকড়ে থাকবি না। আর...”, কাঁধের পাশে চুলগুলো সরিয়ে দিয়েছে- নেভিব্লু ব্লাউজ সরে ফর্সা কাঁধের অনেকটাই উন্মুক্ত তার ঠোঁটের ঠিক নীচে।
মেয়েটা অনেক ছোট। একেবারে বালিকা। করিস না কিছু... উলটাপালটা... হারামজাদা...শুয়োর...করিসনা... নিজেকে গালি দিতে দিতে অজান্তেই ঠোঁট চেপে ধরে সে কাঁধের নরম মাংসে!
টের পায়, কেঁপে উঠছে কুশি।
একবার, দু’বার, তিনবার।

কুশি বুঝতে পারছেনা, যেই স্পর্শ বাঁচানোর জন্য সে ছুটে এসেছিলো বারান্দায়, পুরুষালী সেই স্পর্শে তার এত অন্যরকম লাগছে কেন! ওই লোকটা খুব ইতরের মতো...কিন্তু সমুদাও তাকে খুব শক্ত করে ধরেছে...কেন ঠিক ওরকম লাগছেনা... কেন??

কিন্তু,ভয় লাগছে। অনেক।

বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ।

সমুদা যা করছে, সেটাও ঠিক না। একদম না!

ওফ্‌ফ্‌...কেন...সমুদাও কি তাহলে...

বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে দ্রুত, খুব দ্রুত... সে শ্বাস নিতে পারছেনা, তার দম আটকে আসছে... সে চায়না সমুদা ওই লোকটার মতো হোক... কিন্তু সমুদাকে কিচ্ছু বলতে পারছে না... “প্লিজ...না” অস্ফুটে প্রায় নিঃশব্দে বলতে চেষ্টা করে... পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসে তার চোখের সামনে...

সামিনের ঘোর লেগে গেছে!কুশির গায়ে কি সুন্দর গন্ধ...শ্যাম্পু? না’কি পারফিউম?বাচ্চাদের মতো গন্ধ...এতো নরম...এতো কোমল কিছু...পৃথিবীতে সে আগে কখনো স্পর্শ করেনি! পোষা হরিণ কিমারি’র চামড়াও এ-তো মসৃণ না! উফ্‌ফ্‌! পাগল হয়ে যাবে সে!! কুশির নেতিয়ে পড়া মাথা তার মাথায় স্পর্শ করার পর সহসা সম্বিত ফেরে!

ইশ্‌শ্‌!! মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেছে!!!

শুয়োর  সে একটা...স্রেফ শুয়োর...শি ইজ জাস্ট আ লিটল গার্ল, গ্রোয়িং আপ।। অ্যান্ড ইউ আর আ সেলফিশ ডার্টি বাস্টার্ড...
স্কেয়ারিং হার... অল দ্য টাইম...
নিজের সম্বরণহীন প্রগলভতায় নিজেকে জুতো মারতে ইচ্ছে হয় তার। 

আবার।

প্রথমবার হয়েছিলো কুশির হাত ফেটে রক্ত বেরোতে দেখে।

বারবার কেন, কেন সে এই মেয়েটার সাথে এমন করে?

কেন, এই মেয়েটাকে দেখলে তার যুক্তিবুদ্ধি, লাজলজ্জা, চিন্তাভাবনা উল্টোপাল্টা হয়ে যায়?

কেন? কেন?? কেন???

কুশিকে কোলে তুলে ঘরের দিকে নেয়ার সময় হঠাৎ বাবার মুখোমুখি, বাবা এদিকেই আসছিলো কিছু একটা নিতে... সচকিত হয়ে এগিয়ে আসেন রেজা আলী। কুশি তার নিজের মেয়ের থেকেও সময় সময় বেশি আদরের।

“বাবা, ওর শরীরটা হঠাৎ খারাপ করেছে...গরমে সেন্সলেস হয়ে গেছে...শাড়ি টাড়ি পরার অভ্যাস নেই বলছিলো...এতো চিৎকার চেঁচামেচিও নিতে পারেনি...আমি মা’র ঘরে একটু শুইয়ে দিয়ে আসি...” নিজের ঘড়ঘড়ে গলার স্বরে সব অপরাধবোধ ঢাকেনা সামিনের। বাবার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও অস্বঃস্তি।

“সমু, তুই কি ওকে এলকোহল...”

“না,বাবা...নেভার...” খুব জোর দিয়ে প্রায় আর্তনাদের মতো বলে সামিন। “ও একটা বাচ্চা, মাত্র চোদ্দ বছরের। আউট অফ কোয়েশ্চেন, বাবা!!”

“সেটা আমি জানি, তুই জানিস তো?” জলদগম্ভীর কণ্ঠ।

“বাবা, প্রমিস। সয়্যার, সেরকম কিচ্ছুনা!” তুমি এসো আমার সাথে। আইভী খালা খালুদের আর ডাকতে যেও না। অযথাই টেন্সড হবেন।”

কাল রাতে বাবার কোলে মাথা রেখেই জ্ঞান ফিরছিলো কুশির। সামিন দাঁড়িয়ে ছিলো এক কোণায়, ল্যাম্পশেডের পাশে। বাবা গভীর স্নেহে মাথায় পানি দিয়ে, ভিজে তোয়ালে দিয়ে মুখ মোছালেন, একটু ঠান্ডা পানি খাওয়ালেন, আবার মা’কে বলবেন না আশ্বস্তও করলেন।

বাবার ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে যায় তার।

এবং নিজের ওপর অশ্রদ্ধা

কাল রাতের স্মৃতিটা ফিরে এসে সকালটাকে তেতো করে দেয়। বালিশটাকে আঁকড়ে ধরে ভুরু কুঁচকে ভাবে...

মেয়েটার সামনে তার কন্ট্রোল থাকছে না। ব্যাড।

মেয়েটার তাকে ভয় পায়। হয়তো, হয়তো কেন, নিশ্চয়ই... কালকের ঘটনার পরে অপছন্দও করে। ওয়ার্স।

মেয়েটার বয়স চোদ্দ। শি ইজ এ ব্লাডি টিনেইজার, ড্যাম ইট!! ওয়ার্স্ট!!!!!

চলে যেতে হবে তাকে।

দূরে।

বড় কিছু অঘটন ঘটার আগেই। 


শেষ পর্ব এখানে

২টি মন্তব্য:

  1. ঘটনাপরম্পরায় সামান্য লাফ ছিল, যা আরেকটু গভীরে যেতে পারত মনে হলো। তারপরও পড়ে যেতে আগ্রহে ছেদ পড়েনি। ইংরেজি শব্দের বাহুল্য গতি কিছুটা ধীরে করেছে শুধু। সব মিলিয়ে ভালো লাগল। :-)

    উত্তরমুছুন
  2. লাফ ছিলো সেটা স্বীকার করছি, কিন্তু ইংরেজির বাহুল্যটা মেনে নিচ্ছিনা। যে শ্রেণীর গল্প বলা হচ্ছে, তাতে এই এক্সপ্রেশনগুলো, চিন্তাগুলো ইংরেজিতে হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক ব'লে বোধ হয়েছে আমার কাছে।

    উত্তরমুছুন