রবিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৩

প্রেমের গল্প লেখার অপচেষ্টা পর্ব ১,২


আমরা খুব অস্থির একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। অনেক দূরে, ছোট্ট ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের যে ভূখণ্ডে আমি জন্মেছিলাম, বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটছে তার রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে। নিজেকে কখনো রাজনৈতিক মানুষ বলে বিবেচনা করিনি। সক্রিয় রাজনৈতিক কার্যক্রমের জায়গা আমার জীবনে খুবই অল্প। তারপরেও দিনশেষে আমরা সবাই রাজনৈতিক জীব। বেঁচে থাকার জন্য জীববিজ্ঞানের সংজ্ঞায় প্রোটোপ্লাজমের ভেতরে থাকা অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেই যেমন, ঠিক তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রণোদনা জোগানো চেতনাকে ধারণ করি অনায়াসেই। ঠিক এমনি অস্থির সময়ে প্রেমের গল্প লেখার আইডিয়া আমার মনে কেমন যেন একটা অপরাধবোধের জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু আপাতঃ ঘটনাহীন জীবনে, অনেকগুলো দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে সেই নিষিদ্ধ গন্ধম ফলের হাতছানিকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারছিনা। মগজ বলছে, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, মন বলছে হারাই হারাই সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে। এই টানাপোড়েনে মনের জয় অবশ্যম্ভাবী আমি জানি। কারণ আমি নিজেকে চিনি। পৃথিবীর সবচাইতে সম্পূর্ণ আবেগ আমার কাছে প্রেম। সবচাইতে শুদ্ধ অনুভূতির নাম ভালোবাসা। ভালোবাসা, ভালোলাগা, ঘোরলাগা মুহুর্ত এদের জন্য আমি অনায়াসে ছাড়তে পারি অনেক কিছু। জীবনে অনেক কিছু এ কারণে হারিয়েছি। কিন্তু সুযোগ পেলে আবারও হারাবো। বিশ্বসংসার তুচ্ছ হয় যে ভালোবাসার কাছে, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে আর কিছুই নেই। আমার এই স্বীকারোক্তিটুকুর দরকার ছিলোনা। লেখা হিসেবে এই অংশটুকুকে বাহুল্য আখ্যা দেয়া যায় সহজেই। কিন্তু নিজের কাছে, নিজের শুদ্ধতম আবেগের কাছে, সৎ থাকতে চেয়ে এইটুকু লেখা।

এটা একটা একেবারেই গভীরতাহীন মিলস এন্ড বুন জাতীয় প্রেমের 
গল্প। ছোটবেলায় যে গল্পগুলো পড়ে শিহরিত হতাম অকারণেই,কৈশোরের সেই শিহরণকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। সাহিত্যমূল্য অতিনিম্ন। সাহিত্যমূল্য চিন্তা করলে নিজেকে খুলতে পারছিলাম না। তাই সে চেষ্টায় ইতি দিয়ে শিহরণকেই সঙ্গী মানলাম। 

=======================================


বিনুণিটা কিছুতেই সোজা হচ্ছেনা। উফ্‌ফ্‌!
অসহ্য লাগে কুশির। বারেবারে টান দেয়। চিরুনী দিয়ে সিঁথির ঠিক মাঝখানে ল-ম্বা একটা রেখা আঁকে দ্বিতীয়বারের মতো। দু’দিকে চুল সমান করে, তারপর খুলে আবার বাঁধে। কিন্তু এবারেও একদিকের বেণি একটু মোটা হয়ে যাচ্ছে। 

উফ্‌ফ্‌, উফ্‌ফ্‌, উফ্‌ফ্‌ফ্‌!! অসহ্য!

ঠিক স্কুলে যাওয়ার সময়ে, রাজ্যের তাড়া যখন, অতি অবশ্যই এইসব ডিসগাটিং জিনিসপত্র হতে হবে।

“কুশ, টেবিলে নাস্তারেডি, জলদি আয়” মা’র চিত্কার শুনে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে পাঁচফুট চার পেরিয়ে পাঁচ ছুঁইছুঁই লতানো শরীরের বালিকাটির। দ্রুত ওড়না আর রুমাল ভাঁজ করে কোমরের বেল্টে গুঁজতে গুঁজতে মা’র সামনে তড়িঘড়ি বসে পড়ে। এসময় মা’র মেজাজ পুরো মিলিটারি থাকে, একচুল এদিক ওদিক হ’লেই চড়চাপাটি বিচিত্র কিছু না। ডিম খেতে বমি লাগে, দুধে গন্ধ- কিচ্ছু বলা যাবেনা! আচ্ছা, বুয়াকে কতোবার সে বলেছে, একটু ভ্যানিলা এসেন্স মিশিয়ে দিয়ো।এই কুৎসিত জিনিসটা প্রতিদিন মায়ের অত্যাচারে তাকে মুখ বুঁজে খেতে হয়। একটু সহনীয় করা যায়না ব্যাপারটা? না, তাকে খেতেই হবে। না খেলে লম্বা হবেনা, হাড় শক্ত হবেনা, স্কিন সুন্দর হবেনা, মাস্‌ল বিল্ড হবেনা আরো হাজারটা কথা। এম্নিতেই ক্লাসের সবগুলো মেয়ের মধ্যে সে সবচেয়ে লম্বা, চিকন বেতের মতো ছিপছিপে শরীরের কারণে তাকে আরো লম্বা দেখায়। সাড়ে তেরো পেরিয়ে চোদ্দ বছরে পড়বে সে আসছে অগাস্টে, শরীরের বাঁক এখনো স্পষ্ট হতে শুরু করেনি, কিন্তু তার হাত পা গুলো ইতিমধ্যেই জানান দিতে শুরু করেছে সে আরো অনেক লম্বা হবে। বাবা মা দু’জনেই লম্বা বলে কুশি জানে লম্বা হওয়াটা তার ভবিতব্য, কিন্তু আজকাল ইন্টারনেটে পড়ে, ছবি দেখে যা বোঝে, লম্বা মেয়েদের বাইরের দেশগুলোতে খুব কদর। এদেশে, বন্ধুবান্ধব এমনকী আত্মীয়স্বজনরাও তাকে “কিরে কুশ, ঢ্যাঙঢ্যাঙিয়ে কেবল বাড়ছিসই দেখি, তালগাছ না হয়ে থামবি না না’কি” ইত্যকার নানা বাক্যবাণে জর্জরিত করতে শুরু করেছে।

কুশি যে কথাটা জানেনা, বা ছোট বলে তার মাথায় ঢোকেনা সেটা হ’লো সে দেখতেও ভারী সুন্দর হয়ে উঠছে। ধারালো চোয়াল, পরিষ্কার টলটলে চোখ আর লম্বাটে একটা মুখ। এতটুকু বাড়তি মেদ নেই সে মুখে, কৈশোরের সারল্য লেপটে থাকে তার চাউনিতে আর লালচে গালে। আত্মীয়দের মধ্যে হিংসুটে আর মুখরা বলে পরিচিত অনেক মহিলাই এজন্য তাকে একা পেলে বেশ ঠেস দিয়ে  কথা বলে বা রূঢ়ভাবে খোঁচা দেয় যেগুলোর বেশিভাগই সে বোঝেনা।

সেদিন অর্ণব ভাইয়ার সাথে আনিকার রুমে অনেকক্ষণ স্ক্র্যাবল খেলছিলো, সবাই কখন চলে গ্যাছে পড়া শেষ করে তার মনেও নেই। কুশি খুব মনোযোগী ছাত্রী, শব্দ বানানোর খেলা স্কুলের বাস্কেটবলের পরেই তার জানের জান। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক কেটে গ্যাছে, দু’জনেই খেলায় বেহুঁশ, হঠাত আনিকা অর্ণবের মা ঘরে ঢুকে কুশি আর অর্ণবকে খুব বকাবকি! চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞ চোখ কৈশোরের সারল্য ছাপিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন, কুশির স্কার্টের ঝুল হাঁটুর বেশ কিছুটা ওপরে উঠে রয়েছে, পা মুড়ে বসে খেললেও উরুর অনেকটাই উন্মুক্ত আর অর্ণব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। ব্যাপারটার মধ্যে অশ্লীলতার গন্ধ খুঁজে পাননি রীতা, কারণ দু’টো ছেলেমেয়েই সমবয়সী, তার ওপর তার কোলেপিঠেই মানুষ। কিন্তু সহজাত নারীত্বের একটা ইন্সটিঙ্কট আছে। ব্যাপারটা হঠাত তার রাগ চড়িয়ে দেয়। বেচারা কুশি রীতা খালার ধমকে এক্কেবারে জড়োসড়ো, বিশেষতঃ যখন তাকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে স্কার্ট না পরে পা ঢাকা কিছু পরতে বলেছিলেন এরপর থেকে- তার মাথায় কিছুই ঢোকেনি। পা? পা দেখালে কি প্রব্লেম? বাস্কেটবল কোর্টে কোচসহ তারা সবগুলো মেয়ে শর্টস পরেই তো খেলে! যাইহোক রীতাখালা মায়ের সবচে’ প্রিয় বন্ধু। মায়ের পরেই সবচাইতে বেশি সে যাকে ভয় পায়, ভালোও বাসে। 

কয়েকটা কথা কানে লেগে আছে এখনো। “কুশি তুই জানিসনা, তোকে কতো সাবধানে চলতে হবে। বড় হচ্ছিস, এখন হুটোপুটিতেও রাশ টানতে হবে। আর মেয়ে হচ্ছিস, এটা মনে রাখছিস তো?”

ডিমের কুসুমটাকে মাখন লাগানো রুটির ওপর ব্যালান্স করতে করতে হঠাৎ তার মনে হয়, মেয়ে হওয়া ব্যাপারটা আসলে কী?





“সামিন, সাম-ইন না”বিরক্ত কণ্ঠে ব্যাংকের মহিলাটিকে শুধরে দিচ্ছিলো সে, হঠাত পেছন থেকে ডাক পড়েঃ “এই তুই সমু না?”

দুপুর বাজে দু’টো, কাঠফাটা ভ্যাপসা গরম বাইরে।

সামিন আরেফ রেজা নামের নজরকাড়া তরুণটি আধ ছটাক বিস্ময় আর আধ ছটাক বিরক্তি মিশিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রথমেই যেটা দেখতে পেলো সেটা হাল্কা পাউডার ব্লু স্কুল ইউনিফর্ম। সাদা পাজামা, হকিসু কেডসে ধুলোবালি, পরিপাটি ভাঁজের রুমাল আর ওড়না সাদা বেল্টে গোঁজা। চিকন বেতসলতার মতো শরীর বেয়ে চোখ ওপরে উঠতেই তার দৃষ্টি আটকে যায় সারল্যভরা চোখ আর অভিমানী ফোলা ঠোঁটের মেয়েটির দিকে। নেহাতই বাচ্চা, লম্বা হ’তে শুরু করেছে কেবল। দাঁড়ানোর ভঙ্গীতে বোঝা যায় সেটা নিয়ে সে বেশ বিব্রতও, সদ্য বালিকাবয়স পেরিয়ে কৈশোরের আগমনী তাকে অস্বস্তিতে ফেলতে শুরু করেছে। পেছন থেকে সানগ্লাস কপালে তোলা স্মার্ট মধ্যবয়সী রমণীটি কাছে এগিয়ে আসাতে সামিন খুব পরিচিত একটা সুগন্ধ পায়। ভদ্রমহিলার সাথে মা’র খুব মিল।শাড়িটাও ঠিক মা’র মতোই সফট সিল্ক-সর্ষে রঙের। ফর্সা চেহারায় আর ব্যক্তিত্বে দারুণ মানিয়ে গ্যাছে। লম্বা একঢাল চুল আর বয়সোচিত লাবণ্যে একটুও ঘাটতি না পড়া মহিলাকে হাসি দেখেই হঠাত চিনে ফ্যালে ও। সাথে সাথে এটাও মনে পড়ে যায়, ভদ্রমহিলার আঁচলের সুবাসটা মা’র প্রিয় পারফিউম ড্যাভিডাফ এর কুল ওয়াটার।

“কীরে, তুই পান্নাবু’র ছেলে সমু না? সেদিন তোদের বাড়ি গেলাম শুধু তোকে খুঁজতেই তো। কতক্ষণ আমি, চুনি আর পান্না’বু গল্প করলাম তোর তো দেখাই পেলাম না?” ভদ্রমহিলার কপালে সুন্দর গোল বড় একটা টিপ। চুনি খালা ঠিক এমন করেই টিপ দেয় আর ওর মুখটা কেমন মা মা হয়ে যায়। চুনি খালার প্রাণের বান্ধবী এই আইভী খালামণিকে চিনতে পেরে স্ব:স্তির নিঃশ্বাস ফ্যালে ও। পাশে দাঁড়িয়ে হাতের মুঠোয় বেণী পাকানো কিশোরীর অবয়ব চট্‌ করে আরেকবার লক্ষ্য করে সে। মায়ের সাথে চেহারার মিল প্রচুর। শুধু ঠোঁটের কাছের ওই অভিমানী ফোলাটা... এক হাতে বেণী ধরা আরেক হাতে ওয়াটার বটল থেকে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে... মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকের জোরালো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণও স্কুল ফেরতা ক্লান্তি মুছে নিতে পারেনি...হাতের উলটো পিঠে আল্‌তো করে ঠোঁটের উপরের ঘাম মুছে নেওয়া...কেমন যেন আদুরে একটা ভঙ্গী আছে বাচ্চাটার...নাহ্‌ মেয়েটার...মেয়েটার...নিজের মনের দৌড়োনো চিন্তায় নিজেরই হাসি পেয়ে যায় ওর, পুঁচকে একটা মেয়েকে নিয়ে কী ভাবছে! সেই হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়েই সালাম পর্ব শেষ করে, খালামণি খুবই আদরে কপালে একটা চুমু দিয়ে একেবারে বিব্রত করে দেন ওকে। আইভী রহমান বলতে থাকেন, “সমু, ছোট্টবেলায় তুই আমার কোল ছাড়তেই চাইতি না, হিসি করে আমার জামা ভাসিয়ে দিতি, আর আমাকে কাপড় বদলাতেও দিতি না, তোকে কোল থেকে নামালেও কী কান্না, কী কান্না। মনে আছে, সিঁড়ি থেকে পড়ে যাবার কথাটা?” সেটা খুবই বিব্রতকর একটা গল্প, জামায় হিসি করার থেকেও। সেই বিব্রতভাব কাটানোর জন্য প্রসঙ্গান্তরে যায় সে, আড়চোখে দ্যাখে দুইবেণী বড় বড় চোখ করে গিলছে মা’র কথা! হিসির গল্প শুনতেই ফিক করে হেসে ফ্যালে, আবার চোখে চোখ পড়তেই ভয়ে চট্‌ করে মুখ বন্ধ। 

মেয়েটার সাথে কীসের যেন মিল আছে! কীসের?

“শোন, সমু, বাড়ি গিয়েছিলাম মা বলেছে নিশ্চয়ই। এটা আমার মেয়ে। এবার ক্লাস টেন। ওর ফিজিক্স আর ইলেক্টিভ ম্যাথস আর স্ট্যাটিস্টিক্স দেখানোর জন্য...”

ওহ্‌ হো, এই সেই মায়ের ভাষায় “ভীষণ শুকনো, ভীষণ মিষ্টি, ভীষণ চুপচাপ, ভীষণ লক্ষী, তোর ছাত্রী হবে। ভীষণ করে ধরেছে, প্লিজ না করিস না, বাসায় এসে পড়বে, খুব ঘাবড়ে গ্যাছে, ভীষণ নার্ভাস টেনে উঠে, তোকে দায়িত্ব নিতেই হবে ব্লা ব্লা ব্লা ..”––
কিন্তু আইভী খালা ওকে তো ক্লাস টেনের তুলনায় ছোট লাগছে, কথাবার্তার প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে ওঠার এক পর্যায়ে সামিন বলে ওঠে।

“বয়সের তুলনায় তাড়াতাড়িই টেনে উঠে গ্যাছে রে। আমরা  হিউস্টন থেকে পাকাপাকিভাবে ফিরলাম আর ওকে একবারে ক্লাস ফাইভে ভর্তি করে দিলাম। সে জন্যেই দ্যাখ না তরতরিয়ে লম্বা হচ্ছে, কিন্তু বুদ্ধিশুদ্ধি কিছু হচ্ছেনা! ফিজিক্স আর ম্যাথসে তো ভীষণ ঘাবড়ে গেছে, বলছে বাস্কেটবলে মেজর করবে। গাধা একটা।”

“তুমি বাস্কেটবল খেলতে?” কিছুটা কৌতুক বাকিটা বিস্ময় আর অবিশ্বাসের মিশেলে জিজ্ঞেস করে সে।

“খেলি। এখনো। স্কুল টিমের পাওয়ার ফরোয়ার্ড আমি।” রিনরিনে কণ্ঠ, শুনলে মনে হয় চুড়ির টুনটুন আওয়াজ। বাচ্চাটার সাথে কীসের মিল... ধ্যাত্তেরিকা।। মেয়েটা, মেয়েটা।। নিজেকে নিজেরই চড়াতে ইচ্ছে করে তার। বাচ্চা একটা মেয়ে, তাকে নিয়ে বেশি আদিখ্যেতা হচ্ছে চিন্তার...
“দ্যাটস রিয়েলি গুড! আমিও খেলি, মানে খেলতাম। পয়েন্ট গার্ড ছিলাম।”

দুই বেণীর চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক। নিজেকে সতর্ক করে সে, কী হচ্ছে এসব! অযথা ছোট্ট মেয়েটার সামনে কেন হিরো সাজতে চাইছে। যত্তসব!

দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের দিকে ফিরে কণ্ঠে গাম্ভীর্য টেনে – “মানে আইভী খালা, আমার থার্ড সেমিস্টারের খুব ক্রুশিয়াল টাইম এটা। তাছাড়া টিউটরিং ও করছি ইউনিতে, জি আর ই র প্রেপ, তারপর আব্বু টুকটাক কাজ দেয় ডিজাইনের... আসলে আই’ভ গট মাই প্লেইট কোয়াইট ফুল...”


“শোন্‌ সমু ছোট্টবেলায় তোর এডমিশন টেস্ট-ক্লাস টেস্টের সব ধাক্কা সামলেছি, মধ্যে না হয় এ ক’টা বছর যোগাযোগ নেই, কিন্তু তোকে  এ কাজটা করতেই হবে, না করতে পারবিনা, খবরদার”, হাত চেপে ধরেছেন আইভী খালামণি- “ধরে নে আমার মেয়েটা তোর রেস্পন্সিবিলিটি। যেভাবেই হোক, ওর পড়াশোনাটা তুই সামলাবি।”
ছোটখাটো চাপানউতোর বাক্‌বিতণ্ডা কাটিয়ে স্পষ্টত:ই অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো পড়ানোতে রাজি হতে হয় তাকে। কথাবার্তা সেরে তাড়াহুড়োয় বিদায় নিতে পেরে ওর মনে হ’লঃ বাঁচলাম এখনকার মতো! কী একটা অজানা অস্বঃস্তি ঘিরে ধরেছে তাকে। আইভী খালা কাউন্টারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, বেরুনোর পথে আবারও হঠাৎ চোখ আটকে যায় দুইবেণীর চোখে। মা’র দিকে পিছু ফিরে একদৃষ্টিতে গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সরল, নিষ্পাপ, কিন্তু ভীষণ চঞ্চল চোখের মণি। তীব্র কৌতূহলে হাতের ব্যাগ খসে মাটিতে পড়ে গেলো, মেয়ের খেয়ালই নেই। তারপরেও তাকিয়ে আছে। 

“করবো কি করবো না, করবো কি করবো না” করতে করতে হাল্‌কা নড করে মেয়েটাকে, আর হাত নেড়ে বিদায় জানায়। আচমকাই ওকে অবাক করে দিয়ে আমূল কেঁপে উঠলো মেয়েটা!বোঝা গেলো, তাকিয়ে থাকা ধরা পড়ে যাওয়াতে যারপরনাই ঘাবড়ে গ্যাছে সে। ত্বরিৎ গতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে মা’র দিকে এবাউট টার্ন আর তড়িঘড়ি ব্যাগ সামলানোর ফাঁকে চোরাচোখে আরেকবার চাইতেই বিদ্দ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ে যায় ওর পোষা হরিণছানাটার কথা।

পারফেক্ট মিলে গ্যাছে ওই চোখদু’টো! একদম!

নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে ওঠে ওর ঠোঁটদু’টো,“হরিণছানা, তোমার নামটা তো জানা হ’লোনা!”



পর্ব ৩, ৪, ৫ এখানে


২টি মন্তব্য:

  1. শুরুটা ভালো লাগল। "হরিণছানা" নামটা খুব কিউট হয়েছে। :-)

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. হ্যাঁ, হরিণছানা বললেই আদর করতে ইচ্ছে হয়না? ছোট্ট নরম চঞ্চল কিছুর মতো?

      মুছুন