শনিবার, ১০ জুলাই, ২০১০

পরিবর্তনের হাওয়ায় চীনঃ বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা

নিউইয়র্ক টাইমস এর প্রতিবেদন লিখেছেন ডেভিড বারবোজা (সংক্ষেপিত) ৭ই জুন,২০১০



চীনে ব্যবসা করার খরচ বাড়ছে।



উপকূলীয় কারখানাগুলো বেতন বাড়াচ্ছে, স্থানীয় সরকার ন্যূনতম মজুরি বাড়াচ্ছে, আর বহু অর্থনীতিবিদ যেমনটা ভাবছেন,তেমন হলে চীন তার মুদ্রা রেমিনবি(য়ুয়ান)ইউএস ডলারের বিপরীতে বাড়িয়ে দিতে যাচ্ছে, তার মানে মোটের ওপর চীনের উৎপাদন খরচ অতি অবশ্য বাড়ছে। ইউরোপ আর অ্যামেরিকার তুলনায় যদিও চীনের মজুরি অনেক কম(দক্ষিণ চায়নায় মাসিক ন্যূন-মজুরি ১২৫ ডলার),কিন্তু এই বৃদ্ধির রিপ্‌ল এফেক্ট টিশার্ট থেকে শুরু করে স্নিকার্স, কম্পিউটার সার্ভার, স্মার্ট ফোন সবকিছুরই দাম বাড়িয়ে দেবে, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।



ক্রেডিট সুইসের অ্যানালিস্ট ড্যাং টাও গত দু’দশকের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য চীনমুখী হবার প্রবণতাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। যে “ডিসইনফ্লেশন”তৈরী করে এরা দাম কমিয়ে রাখত, তাতে বড়সড় একটা ধাক্কা লাগতে যাচ্ছে শিগগীর,এমনটাই তাঁর মত। এই পরিবর্তনের পালে দম্‌কা হাওয়া হয়ে এসেছে ফক্সকন টেকনোলজির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, যেখানে তারা ঘোষণা করেছে আগামী তিনমাসের মধ্যে তাদের সব অ্যাসেম্বলি লাইন ওয়ার্কারদের মজুরি দ্বিগুণ করা হবে। ফক্সকন হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইলেক্ট্রনিক্স ম্যনুফ্যাকচারার,যারা অ্যাপ্‌ল কমপিউটার থেকে ডেল এর পার্টস সবই তৈরী করে। এমন সময়ে এই ঘোষণা এলো, যখন দু’টো ফক্সকনের কারখানায় শ্রমিক আত্মহত্যার ঘটনায় কোম্পানিটির লেবার প্র্যাকটিস নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। তাইওয়ানে মূল কারখানা হলেও দক্ষিণ চায়নায় প্রায় ৮ লাখ কর্মী আছে তাদের;ফক্সকনের ভাষ্যানুযায়ী, সেইসব শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান বাড়াতেই এই বৃদ্ধি।



একই পথে হাঁটছে জাপানি গাড়ি প্রস্তুতকারক হোন্ডা। দক্ষিণ চীনের কারখানায় ১৯০০ শ্রমিকের ২৪ থেকে ৩২ শতাংশ মজুরি বাড়াচ্ছে কোম্পানিটি এই আশায় যে,হয়তো এতে গত দু’সপ্তাহ যাবত চলা কর্মবিরতি আর শ্রমিক আন্দোলনের সুরাহা হবে।



এর পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন চায়নার অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান শ্রমিক-প্রভাব আর দ্রুত বর্ধনশীল আহার-বাসস্থানের খরচকে যা অভিবাসী শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতাকে সঙ্কুচিত করছে। বিশ্লেষকরা আরো বলছেন,সরকার আশাবাদী এতে করে কিছু রপ্তানিমুখী কোম্পানি বাধ্য হবে পুরনো প্রডাক্টগুলোর সংস্কার করে নতুন কিছু বানাতে, যে প্রডাক্টগুলো কমদামী(cheap goods)না হয়ে উকৃষ্ট পণ্য(high value goods)হবে। তাতে দেশের সস্তা রপ্তানিদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। চাইনিজ নীতিনির্ধারকরা আরেকটা কারণে বেতন বাড়ানোকে সমর্থন করছেন, চীনে ধনী-দরিদ্রের আয়ের যে ব্যাপক তারতম্য সেটা কমাতে এই বৃদ্ধি সহায়ক হবে বলে তারা ভাবছেন। গত বৃহস্পতিবার চাইনিজ পুরসভা কর্মীদের ন্যূন-মজুরি ২০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৪০ ডলার স্থির করেছে।



জনসংখ্যার পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক চলক হিসেবে পুরো ব্যাপারটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, ইউপেনের চায়না স্পেশ্যালিস্ট মার্শাল মেয়ার বলছেন। কোম্পানিগুলোর জন্য আরও বেশি অস্বঃস্তিকর হচ্ছে চাইনিজ মুদ্রার মুদ্রামান বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা,যার ফলে বহির্বিশ্বে তাদের রপ্তানি পণ্যের দাম আকাশ্চুম্বী হয়ে যাবে। বেইজিং অনেকদিন ধরেই তাদের মুদ্রাকে ফ্রি-ফ্লোট করার কথা বলে আসলেও বিশ্বমন্দায় ধুঁকতে থাকা চীনা কোম্পানিগুলোকে বাঁচানোর জন্য রেমিনবিকে ডলারের বিপরীতে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিলো। রপ্তানিকারকদের সুরক্ষিত করার একমাত্র উপায় ছিলো সেটা।



শ্রমিক খাতে ব্যয় যদিও পণ্যের মূল্যের খুব ছোট একটা অংশ, কিন্তু এতে করে পুরো সাপ্লাই চেইনে যে প্রভাব পড়বে তাতে পণ্য উৎপাদক কোম্পানি দাম বাড়াতে বাধ্য হবে। অনেক ব্যবসায়ীর জন্য ইতোমধ্যেই লাভের পরিমাণ ক্ষীয়মান,এবং দাম আরো বাড়ালে ব্যবসা ভীষণ বড় ধরনের মার খেতে পারে। তখন ভোক্তাদের কাছ থেকে সেই অতিরিক্ত খরচটা উঠিয়ে আনবার জন্য তাদের কোনো একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে। তারপরেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন চীন নিশ্চিতভাবেই একটা অর্থনৈতিক সংস্কারের পথে এগুচ্ছে যাতে করে এর বিরাট “ফ্লোটিং পপুলেশন” বা অভিবাসী জনগোষ্ঠী এই ঋদ্ধির ভাগীদার হতে পারে, যাতে আভ্যন্তরীণ ভোক্তাগোষ্ঠী তৈরী হবে। শ্রমিক খরচ বৃদ্ধি কোনোভাবেই চীনের সস্তা উৎপাদন খরচের সমাধি রচনা করবে না, তবে দেশটির উৎপাদন ব্যবস্থায় একটা বড় পরিবরতন আনবে সেটা নিশ্চিত। ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগানের সেন্টার অফ চাইনিজ স্টাডিজের পরিচালক ম্যারি গ্যালাগারের মতে বিশাল দেশীয় বাজারের উপস্থিতির কারণে চীনের উৎপাদন ব্যবস্থা ধাক্কা খাবেনা। কিন্তু চীন স্বল্পমূল্যের দ্রব্য ছেড়ে বেশি দামী জিনিস বানানোর দিকে এগোবে। তারা আর পৃথিবীর ওয়ার্কশপ হয়ে থাকতে চাইছে না।এবার তাদের লক্ষ্য প্রাযুক্তিক উৎকর্ষসম্পন্ন পণ্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন