ট্যাগে ১৫+লাগানো দেখে কিছুটা বিস্মিত ছিলাম, তারপরও ক্যালিফোর্নিকেশন বলে কথা। চ্যানেল টেনে প্রথম যখন এই সিরিজের ছিটেফোঁটা দেখা শুরু করি, তখন বিজ্ঞাপনের আধিক্যে বেশ খানিকটা আগ্রহ হারিয়েছিলাম সন্দেহ নেই। কেমন কেমন করে খুব প্রিয় এক বন্ধু ততোধিক প্রিয় এক মুহুর্তে খুব সুন্দর একটা কালচে সোনালী মোড়ক কোলের ওপর ফেলে দিতেই এক রমণীর রমণীয় পা আর লাল স্টিলেটো দেখে তৎক্ষণাৎ ঠিক করা, দেখতেই হবে, এক্ষুণি। আরও বেশি আগ্রহ জাগানিয়া ছিলো ডেভিড ডুকোভনির ব্যায়ামহীন স্বল্পমেদ কিন্তু অনধিক চর্চাতেও খেই হারিয়ে না ফেলা শরীরের উঁকিঝুঁকি।
টুইটারিয় ভাষায় বললে ক্যালিফোর্নিকেশন হচ্ছে এক উড়নচণ্ডী বোহেমিয়ান লেখকের ঘর গেরস্থির আকুল বাসনায় ছুটে বেড়ানো। এই বাক্যটার পরস্পরবিরোধিতার মতই আমাদের(পড়ুন পশ্চিমা নগর সভ্যতায় কলমজীবী বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকারী গোষ্ঠীর) জীবনের মধ্যকার অনেকগুলো ফাঁকফোঁকর দেখিয়ে দেওয়া, যৌন-অযৌন-পারস্পারিক বোঝা না বোঝা, শহুরে মধ্যবিত্ত নারীর উভকামী জীবনের স্বাদ চেখে দেখবার কৌতূহল বা মেট্রোসেক্সুয়াল বাবার বেড়ে ওঠা কিশোরী কন্যার কথা অনায়াসেই বলে ছবিটা। টম কাপিনোস ধমাধম ধাক্কা লাগায় কতকগুলো প্রথমেই, হুটহাট সদর গলিয়ে অন্দরে ঢুকে পড়া যৌনতা বা জীবনের অপরিসীম ভারী দিক গুলোর দুর্দান্ত টুইস্টেড হিউমার এর আগে সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটিতেও দেখেছি। সেই সিরিয়ালও প্রিয় ছিল অন্যরকম একটা জীবনবোধ চোখের সামনে তুলে ধরবার জন্য।
যেটা ক্যালিফোর্নিকেশনে আরো ছুঁয়ে যায় সেটা এর সমান্তরালে নয়, অন্তরালে কোথাও বয়ে যাওয়া একটা মিষ্টি প্রেমের গল্প। একদম স্কুল পালিয়ে দেখা সেই সিনেমাগুলোর মত, নায়ক নায়িকার একটু চোখের দেখা বা অল্প একটু কথা বিনিময়ই যেখানে শিহরণ জাগানিয়া। আমার কাছে এর প্রথম আকর্ষণ ওই ধরা সে যে দেয় নাই দেয় নাই প্রেমটুকুই। তারপরও নিপ্-টাকের মত কখনো অবাস্তব বা উচ্চকিত নয় চরিত্রগুলো, বরং বারো পরিয়ে তেরোয় পড়া বেকা নামের মেয়েটাকে কখনও নিজের মতো মনে হয়, কখনওবা গিলমোর গার্লসের মেয়েটার মতো। দ্বিতীয় আকর্ষণ, আরো ভালো করে বললে, অনেকের জন্যই মূল আকর্ষণ এই লেখক চরিত্রটা, হ্যাংক মুডি। কখনও মাসুদ রানার মত মৃত্যুর মুখোমুখি বসে তীব্র যৌনতায় ডুবে যাওয়া, খেই হারিয়ে ফেলা, আবারও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দিকদিগন্তে খুঁজে বেড়িয়ে হারিয়ে যাওয়া লেখালেখি ফিরিয়ে আনা, তারপর ফের অবসাদ আর লিখতে না পারার বেদনায় ডুবে যাওয়া হালে পানি না পাওয়া একটা ডুবন্ত মানুষ।
অনেকগুলো শেড আছে লোকটার চরিত্রের, যেটা আবারও মাসুদ রানার ক্লিশে ট্যাগলাইন দিয়েই বলি: টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায়না। যদিও মাসুদ রানার সাথে তার আপাতঃ মিলকরণের এখানেই সমাপ্তি, কারণ ঠিকভাবে দেখলে ওই মাঝে মাঝে দাড়ি না কাটা আর সবসময়ই পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট কথা বলা লোকটা প্রচুর ঘাত প্রতিঘাতের পরও বাস্তবের কঠিন মাটিতেই দাঁড়িয়ে থাকে। পায়ের নিচ থেকে জমি সরলে ধীরে ধীরে মাথায় যে ফাঁকা অনুভূতিটা হয়, তার চাক্ষুষ সাক্ষী এই মানুষটা, হাজার রকমের খুঁত, নারীপ্রীতি আর আসঙ্গের লিপ্সা হরহামেশা বিরক্তি জাগিয়ে তোলে সবারই, বউয়ের, বাচ্চার, বন্ধুদের, দর্শক হিসেবে আমাদেরও। আপাদমস্তক মেল শভেনিজম দিয়ে গড়া মনে হবে ওকে, প্রথমে। কিন্তু আজকের এই বেবন্ধু জমানায় একসময়ের ঝলকানি লাগা হঠাৎ বিখ্যাত এই লোকটা যে একজন লেখক, পৃথিবীতে তার আসা শব্দ দিয়ে শরীর জয় করতে, শরীর দিয়ে শব্দকে নয়, ওই জিনিসটা মাঝে মাঝে ভুলে বিবর্ণ একটা বিকর্ষণে চলে যায় মুডি। তার প্রাক্তন প্রেমিকা, হলেও-হতে-পারতো স্ত্রীর ভূমিকায় নাতাশা ম্যাকেলহোন আমার এমনিতেই প্রিয়, স্ক্রীনে এলে আদ্ধেকটা সময়ই হাঁ করে তাকিয়ে থাকি - সেই হাভাতেপনা উপেক্ষা করলেও বলতে হয় মহিলা চরিত্রটা ভালোই ফুটিয়ে তুলেছেন, অন্ততঃ এ পর্যন্ত।
ফার্স্ট সিজন দেখে অবধি একটা সুখী সুখী ফুরফুরে ভাবে আছি, ভালোলাগা জিনিস নিয়ে বদনাম করতে একটুও ভালো লাগেনা আমার। সমালোচনা, খুঁত ধরার ছিদ্রাণ্বেষী চেষ্টা তাই দূর অস্ত। তারপরেও ক্যালিফোর্নিকেশন নিয়ে বদনামের অন্ত নেই। অতিরিক্ত যৌনতা, সম্পর্কের গৎবাঁধা ফর্মুলাকে চ্যালেঞ্জ, "অ"নৈতিক(!) জীবনযাপন আরও কত কী! বাঙালি সমাজের ধারেকাছেও যাবেনা এ ছবি, এর ম্যাচ্যুরিটি লেভেল ভিন্ন সে তো বলাই বাহুল্য। দেখবার চোখও ভিন্ন। আমাদের গড়পড়তা মধ্যবিত্তীয় মূল্যবোধ দূরে থাক, মোটাদাগে বললে তথাকথিত "পশ্চিমা" মূল্যবোধও ঠোকর খায় বারবার এই ছবিটার কছে। আমার একটা "বিজলিবাতির ঝলকানি" মেয়ের সাথে চূড়ান্ত রকমের ভালো শরীরী সুখ হলো, তাপ্পর জানতে পারলাম মেয়ের বয়স ষোল - উই সব্বোনাশ! আরো জানলাম এই মেয়ে আমার হলেও-হতে- পারত- বউয়ের হবু সৎমেয়ে। সাড়ে সর্বনাশ! আবার মেয়েটি এক বিষম অ্যাটেনশন সিকিং ডিজঅর্ডারে ভোগা টিপিক্যাল টিনেজার। সারে সারে সর্বনাশ!!! এতগুলো জিনিস পরপর হলে আর কারো জীবনে ঘটলে(আমরা নিরানব্বই শতাংশ ধরেই নিই আমদের জীবনে ঘটবে না বা ঘটার পথ আমরা রুদ্ধ করেই রাখবো, সেটা ভিন্ন গল্প), যে কেউ পুরো নয় আধপাগলা তো হবেই। ওই আধপাগলা মুডির সাথে মোলাকাতের বিষম আগ্রহ জাগানিয়া জায়গাটাই ক্যালিফোর্নিকেশনের মূল নির্যাস বলে মালুম হলো আমার।
আরো একটা কথা হলো এখানে জীবন নিয়ে মধ্যপন্থার কোনো জায়গা দেওয়া হয়নি একেবারেই। হ্যাংক মুডি মানুষটাকে দেখে আমি প্রেমে পড়িনি একদমই,(শঙ্কামিশ্রিত বিস্ময় বললে অনুভূতিটা আরো ভালো বোঝায়), কিন্তু ওর লাগামছাড়া যা কিছু করতে পারার স্বাধীনতা দেখে বারবারই লাগামছাড়া হবার একটা ইচ্ছে মনের মধ্যে চাগাড় দিয়ে উঠছিলো। সেটা ওর বউয়ের সাথে খুনসুটিতেই হোক কি মেয়ের সাথে কথা কি চূড়ান্ত শারীরিক উন্মাদনার শীর্ষসুখে বসে ষোল বছরের মেয়ের গদাম ঘুঁষি -- তারপর আবার যখন ওর অবনমন, ভিন্নতার,বৈচিত্র্যের ভীষণ একটা টালমাটাল অবস্থায় সমবেদনায় চুকচুক করছি, খানিকটা স্যাডিস্ট ধরণের মজাও পাচ্ছি দর্শক হিসেবে, যা হয়েছে বেশ হয়েছে, এইরকম করবি তো এইই তো হবে বলে সর্বসাধারণের আত্মশ্লাঘায় আমি নিজেও বুঁদ হচ্ছি, সেই সময়েই কেন যেন হঠাৎ করে ওর ভালোবাসা, প্রেম জীবন আর লেখার প্রতি আকুল আকাঙ্খা একটা সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে। সিমপ্যাথি নয় এই প্রথম ------কেমন এমপ্যাথি জাগানিয়া মুডিকে দেখে "মনকে চোখ ঠেরে কি লাভ" - নিজেকে এই কথা বলি।
খারাপ বলা যতটা সহজ, খারাপের জন্য গালি দেওয়া বা নৈতিকতার সীমারেখা টানা যতটা স্বঃস্তিকর, ততটাই অস্বঃস্তিকর হয় চরিত্রের খুঁতগুলোর বিনাশী ক্ষমতা জেনেও তার প্রতি মানুষ হিসেবে সহানুভূতি জেগে ওঠাটা। একটা জায়গা আছে, ১ম সিজনের শেষদিকের একটা পর্বে, মুডি আর তার এজেন্ট চার্লি তাদের জীবনের সম্পর্কগুলো নিয়ে কথা বলছিলো, খুব খেদের সঙ্গে সাথে মুডি বলে, ইট'স রিয়েলি রেয়ার টু ফাইন্ড সামওয়ান হু লাভস ইউ ফর হু ইউ আর অ্যান্ড,উই বোথ হ্যাড উইমেন ইন আওয়ার লাইভস হু লাভড আস ফর হু উই আর ডেসপাইট আওয়ার ফ্ল'জ, অ্যান্ড উই বোথ কুডন"ট কীপ দেম। দীর্ঘশ্বাস আর হতাশা মদের শেষ চুমুকের সাথে মিশে এক ঝটকায় মরালিটির বোধ টোধ উড়িয়ে দিয়ে নিজেকে কেমন নাঙা করে দিয়ে যায়,মনে হয় হায়, সত্যিই তো, জীবনের ভালো লাগার,ভালোবাসার সম্পর্কগুলোর মধ্যে আমরা কেবলই একজনকে অন্যজনের মতো করতে চাই, অন্যের জুতোয় পা গলানোর থেকে নিজের জুতোই চেপেচুপে ওর পায়ে ঢুকোতে চাই, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একটা দুর্দমনীয় ইচ্ছেতে। ক'টা সম্পর্ক হয় যেখানে প্রাণ খুলে গলা ছেড়ে আমার "আমিত্ব" নিয়ে আমরা সুখী আর সম্পূর্ণ? এই পাওয়াটুকুই যদি এ লেখকের, এ পুরুষের সবচাইতে বড় পাওয়া হয় এ অবধি, তাহলে থাক্ না, বেচারীর ওটুকুই স্মৃতি। হোক্ না আরেকটু টালমাটাল, লোকটা সুখ পাক, এত ভুল করেও "ঠিক" না হোক, "ভালো"(যদিও সিরিয়ালটা দেখলে হয়তো বুঝবেন ভালো টার্মটা তখন রিলেটিভ হয়ে গেছে) কিছু হোক ওর জীবনে।
তাই আবার যখন ও লেখা ফিরে পায়, বাচ্চাদের মতো খুশিতে হাততালি দিতে ইচ্ছে করে, এমনকি সদ্য ঋতুদর্শী মেয়ে ওর সাথে থাকতে এলেও শহুরে সিঙ্গল প্যারেন্টের অগোছালো জীবনের মাঝে পিতৃত্বের ঢুকে পড়া দেখতেও কেমন একটা মনকেমন করা ভালো লাগা ঘিরে ধরে-- উপমহাদেশীয় দর্শক হিসেবে আমি ওই পয়সা উসুলদের দলেই ঢুকে যাই যখন শেষ দৃশ্যটা দেখি, মানে প্রথম সিজনের শেষ দৃশ্যটা। বলিউডি দুনিয়ার বেতাজ বাদশাহ শাহরুখ খান নাকি একবার বলেছিলেন ভারতীয়(পড়ুন উপমহাদেশীয়) দর্শক সিনেমা হলে গিয়ে নায়ক মারা যাবার দৃশ্য কখনই দেখতে চায়না, নায়ক মরলে ছবি অবধারিত ফ্লপ। ভুখানাঙা স্লামডগ মিলিওনিয়েরারের রেশ লাগা হাই মেলোড্রামার ঘোর আমাকে বলতে চায়, সাধেই কি এটা হোলো, নইলে ছবি হতো অবধারিত ফ্লপ --- শৈল্পিক গুণ বিচারের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট এবং হাইলি ফ্ল'ড আমি এবং আমরা দর্শককুল ফুরফুরে একটা মেজাজ নিয়ে মিষ্টি করে হাসি, যারা দ্বিতীয় সিজন দেখে ফেলেছেন তাদের তর্জনী উঁচোনো আঙুলগুলোকে আপাততঃ "রাখেন তো!" বলার মাধ্যমে।
বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১০
কী দেখছি :ক্যালিফোর্নিকেশন- ভালো থেকো হ্যাংক মুডি
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন