সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৩

সহ্যসীমা

আমার সহ্য করবার একটা খুব ভালো ট্র্যাকরেকর্ড আছে। 
আমি অনেক কিছু সহ্য করতে পারি।
আমার বয়স যখন তেরো, তখন স্টিমারে চড়ে বরিশাল থেকে ফিরছিলাম। সারারাতের ভ্রমণ। একটা রুম আমাকে দেওয়া হয়েছিলো। সেদ্ধ গরমের হাঁসফাঁস থেকে বাঁচার জন্য সে রুমের টেবলের ওপর আটকানো একটা টেবল ফ্যান। আর রাতে যাতে একা ভয় না পাই সেজন্য বরিশাল থেকে আমরা যে বুয়াকে বাবুর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হবার জন্য নিয়ে এসেছিলাম, তার শোবার ব্যবস্থা নিচে। সবকিছু ঠিকঠাকই ছিলো। স্টিমারের দুলুনিতে রাতে ঘুমও এসে গিয়েছিলো ভালো। 

গভীর রাতে গভীরতর ঘুমের চটকা ভেঙে হালকা ব্যথায় চেতনা ফিরে এলো। সচেতন হওয়ার সাথে সাথে ব্যথার তীব্রতাও বাড়লো। বাম হাতের তালু্তে চটচটে তরলের স্পর্শে লাইট জ্বালিয়ে দেখি বিতিকিচ্ছিরি কান্ড। ঘুমের মধ্যে ফ্যানের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। বাম হাতের চারটে আঙ্গুল ফ্যানের ব্লেডের ভেতর যাকে বলে প্রায় ভর্তা হয়ে গেছে। এতোটা কেটেছে যে সাদা হাড় বের হয়ে এসেছে। শিরা কেটে যাওয়াতে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। ওই অবস্থাতেও আমি নিচে শোয়া বুয়াকে জাগালাম না। দাঁতে দাঁত চেপে ওকে ডিঙিয়ে পাশে আম্মার কেবিনে গেলাম। ফিসফিস করে আম্মাকে ডাকলাম। আম্মা জেগে উঠতে প্রথমে তাকে বোঝালাম কিছুতেই যেন সে চিৎকার না করে! লাইটটা জ্বালানো ছিলো না, জ্বালানোমাত্র  ঘরভর্তি রক্তের ফোয়ারা দেখে তার যে চিৎকার তা তো বলাই বাহুল্য! তারপর ডাক্তার, ব্যান্ডেজ, সারারাত পেইনকিলার সকালে স্টিমার ঘাটে ভিড়তেই হাসপাতাল, এন্টিটিটেনাস ইত্যাদি ইত্যাদি। 

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমি খুব কম কেঁদেছিলাম। ছটফট করেছি তীব্র ব্যথায় শুধু। বাকি সময়টা আমি একদম দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছিলাম ব্যথাটা। কীভাবে, জানিনা। আম্মা আজও ঘটনাটা বলার সময় অবাক হয় আমার সহ্যক্ষমতার জোর দেখে।

আরো ছোট যখন, তখন একবার রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে সাইকেলের চাকার স্পোক আমার বাম গালের ভেতর ঢুকে যায়। যদ্দুর মনে পড়ে, তখন আমার চার বছর বয়স। মিটফোর্ডে নিয়ে জ্যান্ত অবস্থায় সেই স্পোক বের করে, একেবারেই কোন এনেস্থেশিয়া না দিয়ে আমার গাল সেলাই করছিলো ডাক্তাররা। আমার মা সেই দৃশ্য দেখতে পারবে না বলে ইমার্জেন্সির বাইরে দাঁড়ানো ছিলো, আর আমার বাবা আমাকে কোলের ওপর শুইয়েও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলো। বারবার তার কোলের মধ্যে যখন আমার ছোট্ট শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছিলো, নিজের অজান্তেই শিউরে উঠছিলো সে। আমি কিন্তু কাঁদিনি, আশ্চর্য!

আরেকবার, আমাদের পুরনো ব্রিটিশ আমলের বাড়ির দরজাগুলো ছিলো ভারী কাঠের। সেই পুরনো দরজার একটার ফাঁকে আমার আঙ্গুল পড়ে থেঁতলে যায়। আমি এতো ভয় পেতাম আম্মাকে যে আধাঘন্টা ধরে আলনার পেছনে লুকিয়ে ব্যথা সহ্য করেছিলাম, তারপরেও তাকে বলিনি। আম্মা রক্ত জমে ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া বুড়োআঙ্গুল দেখে প্রায় মূর্চ্ছা গিয়েছিলো সে খেয়াল আছে।

আরো কতোশতো কাটা ঘা, আরো অনেক বড় যন্ত্রণা- আমি পার হয়েছি।
খুব সহজে বলবোনা, কিন্তু আমি বারেবারে নিজেকে বুঝিয়েছি এটা এক্সিডেন্ট, এরকম হতে পারে, সহ্য করে নিতে হয়। সবসময়ই বোঝাই।

কিন্তু আজ আমার কী যেন হয়েছে। বাংলাদেশে সাভারের কাছে রানাপ্লাজা নামে একটা ভবনধ্বসে হাজার খানেক মানুষ আটকা পড়েছে। দু'হাজারের মতো উদ্ধার হয়েছে, শ তিনেক এর মতো মারা গ্যাছে। টিভির ফুটেজে অল্পকিছু যা দেখেছি, তাতে কেবল চাপা পড়া মানুষের গোঙ্গানি, থ্যাঁতলানো দেহ, ফাটা মাথা, ইঁটের স্তূপ থেকে বেরিয়ে আসা রক্তমাখা কোন দেহাংশ- এইই কেবল দেখছি। দেখে বড় বিপন্ন বোধ করছি।

বীভৎসতা দেখতে আমি ভালোবাসিনা, কিন্তু রক্তমাখা দলামোচড়া পাকানো দেহ, অর্ধেক শরীর আটকে থাকা ব্যাকুল মানুষ এগুলো সহ্য করার ক্ষমতা দিয়ে আমাকে ঈশ্বর সৃজন করেছেন জানতাম। আজ এগুলো দেখে বারবার গা গুলিয়ে ওঠে। কসম খোদার, আমি কখনো ভাবিনি, আমার বাস্তবতা থেকে এতো দূরে, দৈনন্দিন জীবনযাপনের থেকে এতো বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা আমাকে আক্ষরিক অর্থেই বাথ্রুমের বেসিনে নিয়ে হড়হড় করে শরীরের ভেতরের সবটুকু তরল উগরে দিতে বাধ্য করবে! 

আমাকে তো কোনকিছু সহ্য করতে হচ্ছেনা! যা দেখছি, তাও নিজের ইচ্ছেতেই দেখা। কোন জোর জবরদস্তি নেই। এদের সাহায্য করতে যতটুকু পারি চেষ্টাও করছি ক্ষুদ্র সামর্থ্যে। তারপরেও আমার সহ্যশক্তি এতো কমে গেলো কী করে তাই নিয়ে ভাবছি। প্রযুক্তি অনেক কাজের মধ্যে একটি অকাজ যেটি করেছে, সেটি হলো সবরকমের বীভৎসতাকে সবসময়ের জন্য হাতের মুঠোয় এনে দেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আর মানুষ হিসেবে আমার বোধবুদ্ধি চেতনাও লোপ পেতে  বসেছে কবরের আজাবপ্রাপ্ত ওই মানুষগুলোকে দেখার পর। লাশ পচে গিয়ে গন্ধ ছড়াচ্ছে- এতো হাজার মাইল দূর থেকেও সেই লাশের গন্ধ আমার স্ক্রিনে এসে বাড়ি মারে কেন?
এতটা সংবেদনশীল হলে হয়?
এতোটা অস্থির লাগছে, যে পিসি স্ক্রিন অফ করে ঘুমিয়ে গেছি, তারপরেও মুঠোফোনে গভীর রাত্রে সেই ছবি দেখে শরীর মন বিবমিষায় ভরে আছে।

করুণার একটা স্থানকালপাত্র আছে। সহানুভূতির একটা পরিসীমা আছে। সভ্য দুনিয়ার মানুষ হিসেবে, মেয়ে হিসেবে অনেকগুলো স্তরবিন্যাস আছে আমার বোধের। সুবিধাবাদী, প্রথম বিশ্বে বাস করা পেশাজীবী হিসেবে ভাবনারও অনেকগুলো ডাইমেনশন আছে। কিন্তু সব ছিন্নভিন্ন করে রক্তমাখা জড়াজড়ি করে পড়ে থাকা দেহ, আর পিষ্ট দলিত মানুষগুলোর কাতরানি আমাকে কেবল অসুস্থ করে দিচ্ছে।
কোনক্রমেই, কোনভাবেই শান্তি পাচ্ছিনা।
এতোটা ডিস্টার্বড লাগবে সেটা বুঝতে পারিনি।
আমার নিজের ভেতরে কোথাও একটা ভয়, একটা আতঙ্ক আমাকে কেবলই বলছে, আমিও একটা দালানের তলে চাপা পড়ে আছি।
আমার অর্ধেক দেহ বিমের নিচে।
বাকী অর্ধেকটায় কাতরাচ্ছি আমি। নিরন্তর, নিশিদিন।
কিন্তু আমার কান্না,আমার কাতরোক্তি কেউ শুনছেনা।
শুনলেও কারো কিছু এসে যাচ্ছেনা।
কিচ্ছু না।
আমার এতো আসছে যাচ্ছে, আর কারুর কিচ্ছু আসছে যাচ্ছেনা, এই বোধটা কেমন আমি খুব ভালো করে টের পাচ্ছি। খুব ভালো করে।
বাঁচার জন্য নিজের হাত বা পা নিজেকেই কেটে ফেলতে হলে কেমন লাগতো আমার?
আমার নিজের বাচ্চাটা জন্মের পরপরই  অক্সিজেনের অভাবে দম আটকে আমার সামনে মরে গেলে?
আমার সহ্যসীমা কি তখনও খুব বেশি বলে আত্মশ্লাঘা অনুভব করতে পারতাম?
ঠিক কতোটা সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে চাপা পড়া মানুষগুলো জন্মেছিলো বলে আমি মনে করছি?
আমরা মনে করছি?
সহ্যের সীমার শেষ কোথায়?





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন