শুক্রবার, ১২ জুন, ২০০৯

গল্প লেখার গল্প

১৯৭৫ এ আমার প্রথম বই গ্রিমাস বেরুলো। তা থেকে কামানো সাতশো পাউণ্ড দিয়ে যত কম খরচে আর যদ্দিন পারি ভারত ঘুরে দেখবার একটা পরিকল্পনা করলাম। সেই ১৫ ঘন্টা বাস ভ্রমণ আর গরিবি কেতার হোস্টেল বাসের ভেতরই মিডনাইটস চিল্ডরেন এর জন্ম। এটি সেই বছর যখন ভারত আত্মপ্রকাশ করলো পরমাণু পরাশক্তি হিসেবে, মার্গারেট থ্যাচার কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব পেলেন আর বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিব খুন হলেন; স্টুটগার্টে বাদের মেইনহফ গ্যাংয়ের বিচার শুরু হলো, বিল ক্লিনটন বিয়ে করলেন হিলারী রডহ্যামকে, সায়গন থেকে শেষ আ্যমেরিকানটিকে বের করে দেওয়া হলো আর মারা গেলেন জেনারেল ফ্র্যাঙ্কো। কম্বোডিয়াতে খেমার রুজের সেটি ছিলো রক্তাক্ত ইয়ার জিরো। ই এল ডক্টরো এ বছরই প্রকাশ করেন "ragtime", ডেভিড ম্যামেট আ্যমেরিকান বাফেলো লেখেন, আর ইউজিনো মন্টেল নোবেল পান। আমি ভারত থেকে ফেরবার পরপরই ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচন কারচুপির দায়ে অভিযুক্ত হন এবং আমার আঠাশতম জন্মদিনের ঠিক সাতদিন পর জরুরি অবস্থার ঘোষণা দিয়ে স্বৈরাচারী ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেন। এটি ছিলো দীর্ঘমেয়াদী এক অন্ধকার সময়ের শুরু যেটি ১৯৭৭ অবধি শেষ হয়নি। আমি বুঝতে পারলাম, কোন একভাবে শ্রীমতী গান্ধী আমার হলেও-হতে -পারে লেখালেখির মূল ভাবনায় জড়িয়ে গেছেন।

বেশ অনেকদিন যাবত শৈশব নিয়ে আমার কিছু লেখার ইচ্ছে ছিলো, বম্বেতে আমার নিজের ছোটবেলার স্মৃতি থেকে উদ্ভূত ঘটনাগুলো নিয়েও। এখন, ভারতের কূয়োয় আকণ্ঠ পানান্তে, পরিকল্পনায় আরেকটু উচ্চাভিলাষী হলাম। স্মরণ করলাম ভারত স্বাধীন হবার মধ্যরাত্রির সন্ধিঃক্ষণে জন্মানো, আমার এক পরিত্যাক্ত খসড়ার অপ্রকাশিত বই "দ্য আ্যন্টাগনিস্ট" এর একটা ছোট চরিত্র সেলিম সিনাই এর কথা, যে বহুবার আমার কল্পনায় কড়া নেড়ে গেছে।

সেলিমকে নিয়ে পরিকল্পনার শুরুতে বুঝতে পারলাম ওর জন্মের সময়টা এমনই যে লেখার পটভূমিকে আরও বিস্তৃত করতে বাধ্য হবো। ওকে আর ভারতকে যদি জোড় বাঁধতে হয় তো দুই যমজের গল্পই বলতে হবে। তখন আমার মাথার ভেতরে সদা-মানে-খুঁজতে-থাকা সেলিম যেন কথা বলে উঠলো: আধুনিক ভারতের ইতিহাস যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে, তার পুরোটাই ওর কারণে; ওর জাতি-যমজের সেই পালাবদল, যে কোনোভাবে হোক, পুরোটাই ওর দোষে! সেইটেকে মাথায় রেখে বইটা কথকের [সেলিমের] ভাষ্যে বর্ণিত, বর্ণনাশৈলী ওর মতই - কখনও রসিকতাচ্ছলে জোর খাটিয়ে কখনওবা যারপরনাই বকবকানির মতো বলা, আবার আমার ভেতরে ওর করুণ পরিণতির জন্য একটা কেমন সহানুভূতির বিস্তার, এ সব কিছু মিলিয়েই এর জন্ম।এর ওপর আমি আবার ছেলেটি আর দেশটিকে আইডেন্টিক্যাল টুইনস বানিয়ে দিলাম। ভূগোল শিক্ষক এমিল যাগালো যখন মানবদেহের ভৌগলিক বিবরণ দিতে গিয়ে সেলিমের নাককে দাক্ষিণাত্যের উপদ্বীপের সাথে তুলনা করে নির্মম রসিকতা করে, সে নিষ্ঠুরতাটুকুও অত্যাবশ্যকীয়ভাবে আমারই নিষ্ঠুরতা।

পরিকল্পনা মাফিক এগোতে গিয়ে অনেকগুলো সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। সিংহভাগই লেখালেখি জনিত, কিন্তু কোনো কোনোটা ছিলো রূঢ় বাস্তব । ভারতফেরতা আমি ছিলাম কপর্দকহীন নিঃস্ব। মাথার ভেতর ঘুরতে থাকা বইটা হবে লম্বা, খানিকটা অদ্ভুতও, এবং লিখতে অনেক সময় নেবে - এদিকে আমার পকেটে ফুটো কানাকড়িও নেই! অতএব অনেকটা বাধ্য হয়েই আমার বিজ্ঞাপন জগতে প্রত্যাবর্তন। যাবার আগে বছরখানিক ওগিলভি আ্যণ্ড মাথের এজেন্সীর লণ্ডন অফিসে কপিরাইটার হিসেবে কাজ করেছিলাম, যার প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড ওগিলভির অবিস্মরণীয় উক্তি "দ্য কনজুমার ইজ নট আ মোরন, শি ইজ ইয়োর ওয়াইফ" মাথায় গেঁথে নিতে হয়েছিলো। এর ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর (এবং আমার বস) ছিলেন ড্যান এলেরিংটন। কানাঘুষোয় শোনা ওঁর পূর্বপুরুষ রোমানিয়া থেকে এসেছিলো। তাঁর ইংরেজি, উফ্!! এক কথায় বলা যেতে পারে পাগলাটে। অফিসের কিংবদন্তীসম রসিকতা গুলোর একটা ছিলো যখন একবার বিখ্যাত " Drinka pinta Milka day" এর উত্তরসূরী ক্যাম্পেইন হিসেবে উদ্ভট এবং অতি অবশ্যই রোমানিয়ান স্লোগান " Milk goes down like a dose of salts" মিল্ক মার্কেটিং বোর্ডের কাছে পেশ করা থেকে ওঁকে রীতিমতো জবরদস্তি করে নিরস্ত করতে হয়েছিলো !

তখনও ওগিলভি এতটা নাক উঁচু হয়নি, ওরা কিছু আলটপকা কিন্তু স্মার্ট লোককে খণ্ডকালীন ক্রিয়েটিভ রাইটারের চাকরি দিতে রাজি ছিলো। এই সুযোগে আমিও দিব্যি খোসামুদি করতে লাগলাম, ফলাফলে "হাসছি মোরা আহ্লাদী" দলের একজন হিসেবে আমার পুনঃ নিয়োগ। সপ্তাহে দু'তিনদিন কাজ করতাম আরেক খণ্ডকালীনের সাথে ভাগেজোগে, জোনাথন গ্যাথর্ন হার্ডি- দ্য রাইজ আ্যণ্ড দ্য ফল অফ ব্রিটিশ ন্যানি’র লেখক। এজেন্সী অফিস ওয়াটারলু ব্রিজ থেকে শুক্রবার রাতে ফিরতাম কেন্টিশ টাউনের বাড়িতে, লম্বা গরম একটা চান করতাম, সারা সপ্তাহের জঞ্জাল সরিয়ে- জন্মাতাম (অন্ততঃ তখন নিজেকে তো তাই বোঝাতাম ), লেখক হিসেবে।

এখন যখন পেছন ফিরে তাকাই, আমার যৌবনের "আমি" কে দেখে কেমন যেন একটা গর্ব হয়। সাহিত্যের প্রতি এই নিষ্ঠা যাকে শক্তি জুগিয়েছিলো লেখক হবার শপথ নেবার, শত প্রলোভনের তোষামোদি সত্ত্বেও। বিজ্ঞাপন জগতের সুললিত আর সম্মোহনী ক্ষমতার হাতছানি ছিলো ঠিকই , কিন্তু আমি ভাবতাম ওডিসিউসের কথা, জাহাজের মাস্তুলে তার আছড়ে পড়া, তারপরও দিগ্ভ্রষ্ট না হওয়ার কথা।

তবে বলতেই হবে,বিজ্ঞাপন আমায় নিয়মানুবর্তিতা শিখিয়েছে,আর শিখতে বাধ্য করেছে আলসেমি ছুঁড়ে ফেলে আরব্ধ কজের জন্য গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে। সেদিন থেকে নিজেকে অন্যান্য সব (মানে,প্রায় সব) রকমের শৈল্পিক বিনোদন থেকে আত্মবঞ্চিত করে আমার লেখালেখিকে স্রেফ একটা কাজ হিসেবে ধরে নিয়েছি,যা করতেই হবে। মনে পড়ছে ওগিলভিতে আমার কাজের ডেস্কে বসে আমার উদ্বেগের কথা কেননা আমি জানতাম না আমার নতুন বইটার নাম কি হবে! এ সমস্যা সমাধানে তখনকার জরুরী ক্যাম্পেইন ফ্রেশ ক্রীম কেক ( Naughty but Nice),আ্যইরো চকোলেট বার (Irresistibubble) এবং দ্য ডেইলি মিরর সংবাদপত্রের ( Look into the Mirror tomorrow- you'll like what you see ) কাজ থেকে আমি বহু ঘণ্টা দূরে থেকেছি। একদম শেষে আমার হাতে দু'টো শিরোনাম ছিলো এবং আমি সে দু'টোর মধ্যে থেকে কোন্ টাকে বেছে নেবো ভেবে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না ! "মিডনাইট'স চিল্ডরেন এবং "চিল্ডরেন অফ মিডনাইট" এই নাম দু'টো আমি টাইপ করতাম, বারবার, পরপর, একবার মুছে, তারপর আবার! একবার পুরো পৃষ্ঠা ছিঁড়তাম, তারপর আবারও সেই একই কাজ! এরকম করতে করতে একেবারে বিদ্যুচ্চমকের মতো হঠাৎ আমার উপলব্ধি হলো এটা কোনো প্রতিযোগিতা নয়, চিল্ডরেন অফ মিডনাইট অত্যন্ত একঘেঁয়ে কিন্তু মিডনাইট'স চিল্ডরেন সুন্দর একটা নাম! শিরোনামটাকে জানা মানে বইটাকে আরো একটু ভালো করে বুঝতে পারা। এর পরে বইটা লেখা সহজ,মানে একটু সহজ হয়ে গেলো।

অন্য জায়গায় আমি বলেছি ভারতে মুখে মুখে গল্প বলার যে সংস্কৃতি তার কাছে আমার ঋণের কথা, সেইসব মহৎ ভারতীয় সাহিত্যিকদের কথা, জেন অস্টিন আর চার্লস ডিকেন্স এর কথাও- অস্টিনের প্রতি ঋণ সমাজের বেড়াজালে আটকে পড়া সেইসব মেধাবী রমণীদের চরিত্রচিত্রণের জন্য যাদের "ভারতীয় সংস্করণ"দের আমি চিনি, ডিকেন্সের কাছে ঋণী আমি তাঁর বিশাল বম্বে-সম পচাগলা শহরের বর্ণনা আর অসাধারণ নৈপুণ্যে অতিমানবীয় চরিত্র আর পরাবাস্তব চিত্রকল্পগুলোকে একটা "প্রায়-অসম্ভব" পটভূমিতে গ্রথিত করতে পারার ক্ষমতার জন্য। সেখান থেকে তাঁর কৌতুকময় আর অসাধারণ উপাদানগুলো যেন আপনাআপনি বেড়ে ওঠে,বাস্তবের দুনিয়া থেকে পলায়ন নয়, বরং সেগুলো যেন বাস্তবতার পুঞ্জীভূত বহিঃপ্রকাশ। আমি সম্ভবতঃ এও অনেকবার বলেছি যে, আমার আগ্রহ ছিলো একটা সাহিত্যিক উপভাষা তৈরী করবার যেটি ভারতীয় ভাষার ছন্দ ও চিন্তাসূত্রকে সুন্দর করে মেশাবে নিম্নবর্গীয় "হিংলিশ"(Hindi +English= Hinglish) বা "বোম্বাইয়া" (Bambaiyya)র সাথে। বইটার স্মৃতি-বিকৃতি আর স্মৃতিময়তা থেকে বারবার ছিটকে পড়ার প্রতি আগ্রহও পাঠকের কাছে খুব স্পষ্টভাবে ধরা দেবে বলে আমার বিশ্বাস ছিলো। এইবেলা অবশ্য সেসব সত্যিকারের রক্তমাংসের মানুষগুলোকে ধন্যবাদ দেবার একটা উপযুক্ত সময় যাদের থেকে আমার চরিত্ররা ডালপালা মেলে বিস্তার লাভ করেছে- আমার পরিবার, আমার আয়া মিজ্ ম্যারি মেনযিস এবং আমার ছেলেবেলার বন্ধুরা।

আমার বাবা "আহমেদ সিনাই" এর চরিত্রটা নিয়ে এতোটাই ক্ষেপেছিলেন যে আমার সাথে বাক্য-বিনিময় পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারপর উনি আমায় "ক্ষমা" করবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এতে আবার আমি এত ক্ষেপে উঠলাম যে এবার আমিই কথা বন্ধ করে দিলাম বহু মাসের জন্য। আমি বরং বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম মায়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ে। কিন্তু খুব শিগগিরই তিনি বুঝতে পারলেন যে,"এটা শুধু একটা বই, তুই সেলিম নোস, আমি আমিনা নই, এরা শুধুই কতগুলো চরিত্র।" দেখলাম, প্রয়োজনের সময় কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ইংরেজী শিক্ষা বাবার যতটা না কাজে লেগেছিলো, মাথা ঠাণ্ডা রাখার শিক্ষা মা'র কাজে লাগলো অনেক বেশি! বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে আমি চরিত্রগুলোকে যেমন করে গড়েছি তা নিয়ে বোন সামিনও ( যাকে ছেলেবেলায় "গেছো বাঁদর" বলে ডাকতাম )খুশি ছিলো, যদিও এই মালমশলার বেশ কিছুটা ছিলো তার নিজস্ব।

ছেলেবেলার বন্ধুদের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে আমি ঠিক নিশ্চিত নই, স্কুলের বন্ধু আরিফ তায়্যিবালি, দারাব, ফাডলি তালইয়রাখান, কিথ ষ্টিভেনসন আর পারসি কারানজিয়া সবাইকে আমি অবশ্যই ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার চরিত্র সনি ইব্রাহীম, আইস্লাইস, হেয়ার অয়েল, ফ্যাট পারসি আর গ্ল্যান্ডি কিথের চরিত্র চিত্রণে তাদের নিজেদের একটা অংশ ( যদিও সবসময় শ্রেষ্ঠ অংশটুকু নয় )দান করবার জন্য। ইভি বার্নস চরিত্রটার জন্ম হয়েছিলো অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে বেভারলি বার্নসের থেকে, এই সেই মেয়ে যাকে আমি প্রথম চুমু খেয়েছিলাম, সত্যিকারের বেভারলি অবশ্য বাইসাইকেল-নন্দিনী ছিলোনা কখনই, আর অস্ট্রেলিয়া ফিরে যাবার পর ওর সাথে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। চ্যাম্পিয়ন ব্রেস্ট স্ট্রোক সাঁতারু মাশা মিয়োভিচ কিছুটা বাস্তবের আ্যলেঙ্কা মিয়োভিচের আদলে গড়া, কিন্তু ক'বছর আগে সার্বিয়া থেকে আ্যলেঙ্কার বাবার লেখা একটা চিঠি পাই মিডনাইটস চিল্ডরেন এর ব্যাপারে যাতে তিনি সসঙ্কোচে জানিয়েছেন ছোটবেলায় বম্বেতে আমার সাথে পরিচিত হবার কথা তাঁর মেয়ের নাকি বিন্দুমাত্র মনে নেই। সুতরাং এটি বাদ। যাচ্ঞাপিয়াসী আর যাচিতের বিচ্ছেদের সুর বাজাতেই হলো।

আর বাকি রইলো মেরি মেনযেস, আমার দ্বিতীয় জননী, যে আসলে কোনদিনও বিপ্লবী নার্সিংহোম কর্মচারীকে ভালোবাসেনি বা জন্মমুহূর্তে কোনো বাচ্চাকে বদলে দেয়নি,শতবর্ষী জীবন পেয়েও যে আমৃত্যু কুমারী ছিলো আর আমাকে তাঁর ছেলে বলে ডাকতো; সাত আটটি ভাষায় কথা বলার দক্ষতা থাকলেও সে ছিলো নিরক্ষর। তাই সে বইটা পড়তে পারেনি। কিন্তু ১৯৮২ র এক বিকেলে বম্বেতে বসে আমায় জানিয়েছিলো কি ভীষণ খুশি সে এর সাফল্যে! ওঁর চরিত্রটা নিয়ে আমি যা করেছি তাতে যদি ওঁর কোনো আপত্তি থাকতো,ও এ কথা বলতো না।

**(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন